‘মানুষ প্রতিদিনই অভিনয় করে,’ বলেছিলেন মার্লন ব্র্যান্ডো। ভেবে দেখুন। বিমানবালারা তাঁদের প্লাস্টিক হাসি দিয়ে অভিনয় করেন। রাজনীতিবিদেরা তাঁদের দ্বিমুখী মিথ্যার মাধ্যমে অভিনয় করেন। দোকানদার, ব্যাংকার, আমাদের পরিবার, নির্বাহী...সবাই।
ভারতের বিরোধী দলগুলো দাবি করে যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একজন অভিনেতা। যদিও অভিনেতা হিসেবে খুব সুবিধার নয়। দিল্লিতে রাজ কাপুরের নাতি-নাতনিদের এবং তাঁদের সঙ্গীদের সঙ্গে গত সপ্তাহে মোদির দেখাসাক্ষাৎ হলো। তাঁরা সবাই সিনেমা তৈরির সঙ্গে যুক্ত। মোদি সেখানে গিয়েও অভিনয় করলেন।
তাঁদের মধ্যে এই সাক্ষাৎ ছিল এক হিসেবে অদ্ভুত। কারণ, মোদি আর সবকিছুর মতো চলচ্চিত্রেও সাম্প্রদায়িকতার পৃষ্ঠপোষক। আর রাজ কাপুরের সিনেমাগুলো ছিল প্রবলভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। নাতি-নাতনিরা মোদিকে জানান যে তাঁরা অভিনেতা-পরিচালক রাজ কাপুরের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করছেন। রাজ কাপুর জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৪ সালে পেশোয়ারে পৃথ্বীরাজ কাপুরের পরিবারে। সেই পেশোয়ার এখন পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে পড়েছে। পৃথ্বীরাজ কাপুরের পরিবার ছিল সেই সময়ের অভিনয়জগতে প্রথম সারির।
এ উপলক্ষে রাজ কাপুরের দুই প্রপৌত্র একটি তথ্যচিত্র তৈরি করছেন। তবে বিষয়টাকে তাঁরা কখনোই ব্যক্তিগতভাবে দেখেননি। রাজ কাপুর এখানে ভারতের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে চিহ্নিত হয়েছেন। মোদি নিজেকে সব জায়গাতেই নিজেকে শিক্ষক হিসেবে জাহির করেন। এখানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মোদি সম্ভাব্য তথ্যচিত্র নিয়ে গবেষণার খুব প্রশংসা করেন। বলেন, সত্য খুঁজে বের করা সব সময়ই খুব কাজের জিনিস। মোদিকে ঘিরে ছিলেন তারকা আর মুগ্ধ দর্শনার্থীরা। তাঁদের তিনি জানান যে তিনি চীনে রাজ কাপুরের গান শুনেছেন। এ কথা শুনে সবার মুখ হাঁ হয়ে আসে। যদিও সেটি ছিল সম্ভবত ভান করা বিস্ময়।
রাজ কাপুরের বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুর একটি বিখ্যাত সিনেমায় হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্য দেখিয়ে সম্রাট আকবরের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৬১ সালের সিনেমা মুঘল-ই-আজম ছিল একটি অসাধারণ কীর্তি। মুঘল যুগের এই প্রেমের গল্প গান্ধী-নেহরুর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। হিন্দু রাজপুতদের সমর্থন ছাড়া ভারতে মুঘল শাসনের কল্পনা করাও কঠিন। তবে আয়োজক কাপুর পরিবারের নাতি-নাতনিরা সাহস করে মোদিকে তাঁদের দাদার এই অসাধারণ চরিত্রের কথা বলেননি।
রাজ কাপুরের সিনেমাগুলো অনেক সময় অতিরঞ্জিত আবেগে ভরা থাকলেও সেগুলো কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হয়নি।
নেহরুবাদী ভারত যে গভীর ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, রাজ কাপুরের সিনেমা সেই মূল্যবোধ ধরে রেখেছিল। তার গল্পগুলো রুপালি পর্দায় ভারতে সমতার স্বপ্নকে ফুটিয়ে তুলত। সাধারণ দর্শক তা খুব পছন্দ ও প্রশংসা করতেন।
দিলীপ কুমার ও দেব আনন্দের সঙ্গে রাজ কাপুর কয়েক দশক ধরে মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রজগতে রাজত্ব করেছেন। তাঁর আগের প্রজন্মের মোতিলাল, বলরাজ সাহনি এবং এ কে হাঙ্গালও ছিলেন লক্ষণীয় রকম সমাজসচেতন। পাকিস্তানি বা ভারতীয় সংখ্যালঘুদের অপমান করে এমন চলচ্চিত্র তাঁরা এড়িয়ে চলতেন।
১৯৬১ সালের সিনেমা ধর্মপুত্র-এ রাজ কাপুরের ছোট ভাই শশী কাপুর একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদীর নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। চলচ্চিত্রটি ছিল সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের একটি সাহসী সমালোচনা। শশী কাপুর এখানে এমন মুসলিম শিশুর চরিত্রে অভিনয় করেন, যাকে হিন্দু হিসেবে লালন-পালন করা হয়। বড় হয়ে সে নিজের অজান্তে তার মুসলিম মা–বাবার বিরুদ্ধেই ঘৃণার বাণ ছোড়ে।
রাজ কাপুর তাঁর কাহিনির চেয়ে গানগুলো দিয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিলেন। এই গানগুলো বামপন্থী কবিদের লেখা। সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজ কাপুর জনপ্রিয় ছিলেন। রাশিয়ানরা তাঁর সিনেমার গান গাইতে পছন্দ করতেন। এসব বিষয় মিলিয়ে দেখলে মোদির সঙ্গে কাপুর পরিবারের এই অদ্ভুত সাক্ষাতে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ, কাপুর পরিবারের সদস্যরা মোদির ‘স্পিরিট’ এবং ‘শক্তি’র প্রশংসা করেছেন পঞ্চমুখে। যেখানে কিনা মোদি নিজে প্রায়শই জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনার মুখে পড়েন।
কাপুর পরিবারের মেয়ে রিমা জৈন এবং পুত্রবধূ নীতু সিং তাঁদের সন্তানদের মোদির সামনে হাজির করলেন। একি শুধু সময়ের দাবি? যেভাবে অ্যাপল ও অ্যামাজনের মতো মার্কিন করপোরেট নেতারাও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন? ভারত স্বাধীনতা লাভের পর দেশ গঠনের দায়িত্ব নেয় শিক্ষিত সমাজ। তরুণ চলচ্চিত্রজগৎ সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা সৃজনশীল চিত্রনাট্য এবং সুরেলা গানের মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করে নেয়।
রাজ কাপুর বাণিজ্যিকভাবে সফল অনেক চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। সিনেমাগুলো প্রগতিশীল কাহিনি এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী থিমের জন্য প্রশংসিত হয়েছে। তাঁর এই প্রচেষ্টায় সাহায্য করেছিলেন কমিউনিস্ট গীতিকার শৈলেন্দ্র, সাহির লুধিয়ানভি ও মজরুহ সুলতানপুরী। মোদি যখন কাপুর পরিবারের সঙ্গে এই সাক্ষাৎ করছেন, সেই সময় এক ব্যবসায়ী মুম্বাইয়ের একটি বস্তির জমি দখলের জন্য ফন্দি আঁটছেন। সে কথা ভাবলে সাহিরের গানটি মনে পড়ে, ‘যত বিল্ডিং ছিল, সব শেঠেরা দখল করেছে/ ফুটপাতই আমাদের একমাত্র আশ্রয়।’
অনেকেই তাঁদের ভাগ্য আরও ভালো করতে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিচ্ছেন। হয়তো কাপুর পরিবার আর মোদিও প্রমাণ করছেন যে মার্লেন ব্র্যান্ডো ঠিকই বলেছিলেন।
● জাওয়েদ নকভিডন-এর দিল্লি প্রতিনিধি, ডন-এ প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনূদিত