সুখী দেশের সাম্প্রতিক তালিকায় বাংলাদেশের ২৪ ধাপ অবনমন আমাদের আক্ষেপ বাড়িয়ে দেয়। ১৩৭টি দেশের মধ্যে ১১৮তম, সুখের বিপরীত দিকেই আমাদের অবস্থান ইঙ্গিত করে! বাইরের এই মূল্যায়নের মানদণ্ড হচ্ছে—সামাজিক সহায়তা, আয়রোজগার, স্বাস্থ্য, স্বাধীনতা, সম্প্রীতি এবং দুর্নীতির অনুপস্থিতি, যেগুলোর আলোকে আমাদের অবস্থা কিছুটা যাচাই করা যায়।
সত্যিই দেশের মানুষের মনে আনন্দ আছে কি না, তাদের সম্মিলিত অনুভূতি আমরা জানতে পারব কীভাবে? জাতীয়ভাবে আমরা কতটা আশাবাদী, সে গবেষণার উদ্যোগ তো নেই আমাদের। অবশ্য আন্দাজে বলাই যায়, পুরোনো প্রজন্মের ‘আকাঙ্ক্ষা’ নতুনদের মধ্যে ততটা জাগেনি। শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেকারত্বের দাপটে আজকের তরুণদের ‘প্রত্যাশা’ বরং জীবনযাপন ঘিরেই আবদ্ধ। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং দু-চারটি বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ বাদ দিলে মহতী উদ্যোগে তাদের খুব একটা দেখা যাচ্ছে না এ সময়ে। বড়রাও তারুণ্যের উদ্যাপন ও নেতৃত্ব বিকাশের পরিবেশ উপহার দিতে পারেননি সেভাবে।
জাতীয় উন্নয়নের আলোচনায় তরুণেরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এটা বলা তাদের খামাখা প্রশংসা বা সমালোচনা করার উদ্দেশ্যে নয়। সমাজ-সংসারের জ্যেষ্ঠরা নেতৃত্ব দেন পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে, তাদের মঙ্গলের জন্য। তবে যাদের জন্য এই উন্নয়ন, তারা কী তা অবগত? ‘বুড়োরা’ও কি সব জানেন যে বেড়ে ওঠা জনগোষ্ঠী আর অনাগত ভবিষ্যতের মানুষের কী কী প্রয়োজন? আপনি তো নিজেই পুরোনো, চেনাদের কাছে বন্দী!
এই অবস্থায় ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী, কনিষ্ঠরাসহ এক বিশাল জনগোষ্ঠী, সুনির্দিষ্টভাবে মিলেনিয়াল ও জেন জেড, উন্নয়নযাত্রায় প্রতিনিধিত্বহীন থেকে যায়। অথচ তাদের চিন্তা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যত অসম্ভব। আব্রাহাম লিংকনের আদলে বললে, এই তরুণ ‘জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য’ হওয়া উচিত জাতীয় অ্যাজেন্ডা।
প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের যেকোনো প্রান্তের একজন যুবক তার ইচ্ছা পূরণ ও ভবিষ্যৎ গড়ার প্রচেষ্টায় কতখানি স্বাধীন? এই তরুণ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে তাদের দেখা হচ্ছে অন্যদের সেবা করার পাত্র হিসেবে, পরিবর্তনের নায়ক হিসেবে নয়! উল্টো করে ভাবলে, বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্র বানাতে হলে দরকার উন্নত নাগরিক আর তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। সে জন্য গড়তে হবে যে মানুষদের, তারা কারা?
একই সঙ্গে উন্নয়নের তাগিদে ‘গরিবি হটাও’ বলে দরিদ্র তরুণদের হটিয়ে দিলে গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জিডিপিতেও যোগ হবে না বিশেষ কিছু। দেশে-বিদেশে রোজগার করা শ্রমজীবী মানুষের বংশধরকে উন্নত জীবনে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে নতুন কিছু করতে হবে। অন্যদিকে উচ্চ-মধ্যবিত্তের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ গমন বা দেশে ‘চিল’ করার প্রবণতা বুঝিয়ে দেয় সমাজব্যবস্থায় তাদের বিচ্ছিন্নতা।
বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির যুগে আপনি আবার কাউকে দেশবন্দীও করতে পারেন না। আমাদের ভাই-বোনদের আপন করতে যদি ব্যর্থ হই, সে দায় কার? সমাজ জীবনে ষাট বা সত্তর দশকের সেই উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা...যেমন ‘এ জীবনে যতটুকু চেয়েছি, মন বলে তারও বেশি পেয়েছি’...এখন আর নেই। প্রযুক্তি ব্যবহারের অস্থিরতা ছাড়াও কিশোর-কিশোরীরা আজ বড় হয় টেক্সট বইয়ের বোঝা আর অতি শিখনের চাপ এবং তরুণ-তরুণীরা দুশ্চিন্তা করে সরকারি চাকরি, করপোরেট প্রতিযোগিতা বা বিদেশে কঠিন জীবন নিয়ে।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ছেলেমেয়েদের দরকার নানা ধরনের সুযোগ, বিশেষ করে মানসম্মত শিক্ষা ও কর্মসংস্থান, উন্নত চিকিৎসা, সুন্দর নগরী ও নাগরিক সুবিধাদি, বৈশ্বিক পর্যায়ে মেধা প্রদর্শন, ভ্রমণ ও বিনোদন আর সৃজনশীল উদ্যোগের জন্য নিয়মতান্ত্রিক দেশীয় পরিবেশ। এ ক্ষেত্রে দু-চারটি মতামত লেখা, সেমিনারের বক্তব্য বা আমলাতান্ত্রিক উন্নয়ন দলিলের চোস্ত প্রস্তাবও খুব কমই কার্যকর হয়, যদি না তার রাজনৈতিক মালিকানা থাকে। আর প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ছাড়া নাগরিকদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানো যায় না। বৃদ্ধ কিংবা যুবক—যারই হোক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থপর চিন্তা যে সমবেত মুক্তির পথ দেখায় না, সে কথা শুধুই অক্ষর দিয়ে লিখে কাজ হয় না।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে দীর্ঘ সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোটাদাগে একটি প্রজন্ম, যাঁরা বয়সের শেষ প্রান্তে আছেন, অনেকে চলেও গেছেন। তাঁরা একসময় তরুণ অবস্থায়ই নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, অধিকাংশেরই হয়তো তা মনে নেই। ফলে দেশ এখন আগামী নেতৃত্ব নির্বাচনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে। প্রজন্মের আলোকবর্তিকা হস্তান্তর না করাটা কারও জন্যই সম্মানের নয়।
যে কথাটি নিজেদের নতুন করে বলা আবশ্যক তা হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি তরুণসহ সব মানুষের। যেখানে রিপাবলিক মানেই জনগণের রাষ্ট্র, তার আগে আবার লেখা হয়েছে ‘গণ’—গণপ্রজাতন্ত্র। জনগণ যদি দেশের মালিকানা বঞ্চিত হন বা দেশকে নিজের মনে করতে না পারেন, সেখানে রাষ্ট্রের মেরামত করাটা আসলেই জরুরি হয়ে পড়ে। সেই সংস্কারের উদ্দেশ্য যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠান, যুগোপযোগী আইনকানুন, সুশাসনের সংস্কৃতি, যোগ্য নেতৃত্ব এবং সুনাগরিক গড়ে তোলা। যাতে জনগণের অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি পাওয়াটা ব্যক্তি শাসকের দয়াদাক্ষিণ্যের ব্যাপার না হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদের সঙ্গে যুবসমাজও কোন প্রক্রিয়ায়, কাদের দেশের সেবক নিয়োগ করবে, সে বিষয়ে তাদের সম্মতি নেওয়ার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থাকা উচিত। তাদের চিন্তাভাবনা বা প্রত্যাশার মূল্য কী, তা বোঝার তেমন কোনো উপায় নেই রাজনৈতিক আলোচনা ছাড়া।
অন্যত্র তাদের বক্তব্য ও দাবির প্রতিফলনের সুযোগই-বা কোথায়? ছাত্রাবস্থা থেকে নেতৃত্ব গুণ প্রকাশের পরিবেশ না থাকলে দেশ ভবিষ্যতের নেতা পাবে কোন ‘বাজারে’? আমরা ভুলে যাই, ১৮+ বাংলাদেশিরা আজকেরও নাগরিক, আগামী দিন তো বাকিই। তাদের ছাপোষা বা দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ বানাতে পারলে, তথাকথিত ভদ্রলোকেরা রাজনীতিবিমুখ বা নির্বাসনে থেকে যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
সর্বসাম্প্রতিক তারুণ্যের বিচ্ছিন্নতাবোধ আসলে রাজনীতির সংকটের আরেকটি চেহারা। আমাদের ‘বড় ভাই’দের যুগে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ১৯৯০-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কারা সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন, তা এখন ইতিহাসমাত্র। সে তুলনায় বর্তমান ছাত্র-যুবকদের একেকজনের চাওয়া বড়ই নগণ্য এবং দলগতভাবে তারা কিছুটা দুর্ভাগাও। অনেকের ক্ষেত্রে ‘মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ চলে গেলেও শুভ জাতীয় পরিবর্তনে অবদান রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আবার বড়রা সব সময় ছোটদের চামচে করে খাইয়ে দেবেন, ইতিহাস অমন সরলরেখায় চলে না!
গত শতাব্দীতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের মানের মানুষেরা তরুণ বয়সে এবং জীবদ্দশাতেই ইতিহাস বদলে দেন। ১৯৬৩-তে তাঁর ‘একটি স্বপ্ন আছে আমার’ মহা সমাবেশের ডাক প্রতিধ্বনিত হয় ১৯৬৫-তে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভোটাধিকার আইনে স্বাক্ষর করেন। ওই দশকেই ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা মোহাম্মদ আলী বক্সিং থেকে বিতাড়িত হন ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণে অস্বীকার করায়। শেষ বিচারে ২৫ বছর বয়সী প্রতিবাদী আলীর মুখাবয়বই হয়ে ওঠে ওই প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি।
আমরাও যুবাদের মধ্যে দেখতে চাই চলমান দশকের জানালা। গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে তাদের সন্তানদের সম্ভাবনা নিয়ে। তাই দ্বিতীয় প্রজন্মের স্বপ্ন ধারণ ও বাস্তবায়নই হয় আধুনিক কালে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের ভিত্তি। একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে ব্যক্তি তরুণের বিকাশের সুযোগ যত বেশি, অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা ততটাই বাধাগ্রস্ত।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে দীর্ঘ সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোটাদাগে একটি প্রজন্ম, যাঁরা বয়সের শেষ প্রান্তে আছেন, অনেকে চলেও গেছেন। তাঁরা একসময় তরুণ অবস্থায়ই নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, অধিকাংশেরই হয়তো তা মনে নেই। ফলে দেশ এখন আগামী নেতৃত্ব নির্বাচনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে। প্রজন্মের আলোকবর্তিকা হস্তান্তর না করাটা কারও জন্যই সম্মানের নয়।
পরিবারে অভিভাবকের অদূরদর্শিতার মতোই ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের ব্যর্থতায় একটি দেশে দীর্ঘ মেয়াদে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে নিষ্পাপ শিশু-কিশোরেরা। এ মুহূর্তে আমরা প্রজন্মান্তরের এক ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে, ঐতিহাসিক পালাবদলের অপেক্ষায়। তাই আমরা একটু চেষ্টা করতে পারি তাদের জন্য ন্যায়বিচারের পরিবেশ তৈরির, যাতে তাদের কাজ নিজেরা করে খেতে পারে। কবি কাহলিল জিবরানকে উদ্ধৃত করে বললে, ‘আপনার সন্তানদের আপনি দিতে পারেন ভালোবাসা, চিন্তা ভার নয়। কারণ, তারা বসবাস করে আগামীকালের ঘরে, যেখানে আপনি যেতে পারেন না—আপনার স্বপ্নেও।’
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক