কান্টের শান্তির দর্শন: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উন্নতি যেভাবে সম্ভব

বাংলাদেশ বর্তমানে এক সংকটময় কাল অতিক্রম করছে, যেখানে একদিকে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রচেষ্টা চলছে। অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমে অবনতির দিকে যাচ্ছে।

সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বর্তমান সরকার নতুন একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, সংসদ, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে এবং আইনসভার সামগ্রিক কাঠামো নির্ধারণ করতে সহায়তা করবে। একই সময়ে, বিশ্ব বর্তমানে গাজায় ও ইউক্রেনে দুটি বড় সংঘাত প্রত্যক্ষ করছে, যা কোনো না কোনোভাবে বিশ্বের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলছে।

এই প্রেক্ষাপটে হঠাৎই ইমানুয়েল কান্টের শান্তির দর্শনের কথা মনে পড়ল এবং তৃতীয়বারের মতো তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনা, ‘আ পারপেচুয়াল পিস: আ ফিলোসফিক্যাল স্কেচ’ পড়তে শুরু করলাম। ‘আ পাপেচুয়াল পিস (১৭৯৫)’ রাজনৈতিক দর্শনের ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যা বিভিন্ন দেশের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে।

এই বইয়ে কান্ট যুদ্ধ এড়ানোর ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক ও নৈতিক নির্দেশনা উপস্থাপন করেছেন। পশ্চিমা আধুনিক দর্শনের প্রভাবশালী দার্শনিক কান্ট ১৭২৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং একাধিক যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভবিষ্যতেও যুদ্ধ অনিবার্য। এমন আশঙ্কাই সম্ভবত তাঁকে যুদ্ধ–সম্পর্কিত তত্ত্ব এবং তা প্রতিরোধের জন্য বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা প্রস্তাব করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

বইটিতে কান্ট এমন সব ধারণা উপস্থাপন করেছেন, যা পরবর্তী সময় গণতান্ত্রিক, বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শান্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তাঁর বইটি আধুনিক গণতান্ত্রিক শান্তিতত্ত্বের সঙ্গে মিল খুঁজে বের করে। কারণ, তিনি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলো নিয়ে আলোচনা করেন, যাকে তিনি আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজনসহ প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।

কান্ট যুক্তি দেন, প্রজাতন্ত্রগুলো স্বাভাবিকভাবেই একে অপরের সঙ্গে শান্তিতে থাকবে। কারণ, অন্যান্য ধরনের সরকারের তুলনায় তাদের শান্তিবাদের প্রতি বেশি ঝোঁক থাকে। তবে, কান্ট এ-ও বলেন যে কেবল প্রজাতন্ত্রী সরকারই স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে পারে না। সার্বজনীন উদারতা ও বন্ধুত্বের নীতিতে গঠিত মুক্ত রাষ্ট্রের ফেডারেশন চিরস্থায়ী শান্তিতে পৌঁছাতে পারে, কিন্তু তার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে।

এসব শর্তেরই একটি রূপরেখা প্রফেসর কান্ট দিয়েছেন তাঁর ‘পাপেচুয়াল পিস’ তথা ‘চিরস্থায়ী শান্তি’শীর্ষক বইয়ে, যা দর্শনশাস্ত্রে ছয় দফা কর্মসূচি হিসেবে খ্যাত।
এই ছয়টি নীতি নিম্নরূপ:
১. গোপন চুক্তি নয়: কান্ট জাতিগুলোর মধ্যে প্রতারণা ও অবিশ্বাস রোধে আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বচ্ছতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
২. স্থায়ী সেনাবাহিনী নয়: তিনি স্থায়ী সামরিক বাহিনী বিলুপ্তির পক্ষে যুক্তি দেন। বলেন, তাদের সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব, শান্তির জন্য একটি স্থায়ী হুমকি সৃষ্টি করে এবং সংঘাতের সম্ভাবনাকে উসকে দেয়।
৩. সামরিক উদ্দেশ্যে জাতীয় ঋণ নয়: যুদ্ধের অর্থায়নের জন্য জাতিগুলোর ঋণ নেওয়া এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ, এটি অর্থনৈতিক শোষণ ও দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতকে উৎসাহিত করে।
৪. অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়: জাতীয় সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে অন্যদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. ভবিষ্যতের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমন কোনো শত্রুতামূলক কাজ নয়: জাতিগুলোকে এমন কর্মকাণ্ড এড়িয়ে চলতে হবে, যা আস্থা নষ্ট করে এবং ভবিষ্যতের শান্তি আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করে।
৬. জোরপূর্বক সংযুক্তি নয়: বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আঞ্চলিক সম্প্রসারণ অন্যায্য এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য এটি নিষিদ্ধ করা উচিত।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এসব নীতি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। উদাহরণস্বরূপ, দুই দেশের মধ্যে কিছু চুক্তি গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছিল, যার ফলে জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। স্বচ্ছতার এই অভাব ভারত ও বাংলাদেশ—উভয় সরকারের বিরুদ্ধেই ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। হাসিনা সরকার অপ্রয়োজনীয় মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান এবং অন্যান্য সামরিক অস্ত্র কেনার জন্য প্রচুর বিদেশি ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশের এই অবস্থা সরাসরি কান্টের তৃতীয় নীতির সঙ্গে মিলে যায়।

কান্টের চতুর্থ নীতি, অর্থাৎ অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা আজ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জড়িত থাকার কারণে দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। একইভাবে, কান্টের ষষ্ঠ নীতি, যা জোরপূর্বক দখলের নিন্দা করে, সমসাময়িক ভূরাজনৈতিক সংঘাতে উদ্বেগজনক অনুরণন খুঁজে পায়। ইউক্রেনে রাশিয়ার এবং গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন প্রমাণ করে, সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন কীভাবে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত হতে পারে, ইমানুয়েল কান্ট বহু আগেই তা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। শক্তিশালী রাষ্ট্রের অন্য রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপের এবং আগ্রাসনের পরিণতি সম্পর্কে কান্টের দূরদর্শিতা কল্পণাকেও হার মানায়।

কান্টের শান্তির দর্শন আজকের জটিল ও আন্তসংযুক্ত বিশ্বেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কান্ট মানবিক যুক্তিবাদ, স্বায়ত্তশাসন ও আইনের শাসনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করে সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এক কালজয়ী কাঠামো নির্মাণ করে গেছেন। আন্তর্জাতিক সংঘাত নিরসরণে, মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরিতে কান্টের তত্ত্ব প্রয়োগ করা জরুরি। আধুনিক ভূরাজনীতির জটিলতা অতিক্রম করার সময়, কান্টের শান্তিময় বিশ্বব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি এখনো একটি ন্যায়সংগত ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশ্বিক সম্প্রদায় গঠনের প্রচেষ্টাকে অনুপ্রাণিত করে।

ইমানুয়েল কান্টের শান্তির দর্শন জাতিগুলোর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সম্প্রীতি অর্জনের জন্য একটি গভীর ও স্থায়ী রূপরেখা প্রদান করে। রাজনৈতিক, আইনি ও নৈতিক উপপাদ্যগুলোকে একত্র করে কান্ট যুক্তিবাদ, স্বায়ত্তশাসন ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিস্তৃত দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। আমরা যখন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালাই, তখন মানবজাতির জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচার অনুসরণের নৈতিক কর্তব্য আমাদের স্মরণে আসে।

দর্শনশাস্ত্রের প্রভাব মূলত মানুষের মনোজগতেই ক্রিয়াশীল, কিন্তু কান্টের ‘শান্তির দর্শন’-এর প্রভাব বাস্তব জগতেও ব্যাপক এবং একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী নির্মাণে চিরকালই প্রাসঙ্গিক থাকবে। কান্টের ধারণাগুলো জাতিসংঘের মতো আধুনিক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এবং আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের মতো ধারণার বৌদ্ধিক ভিত্তি স্থাপন করেছে। স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর একটি ফেডারেশন গঠনের জন্য তাঁর আহ্বান কূটনীতি ও আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সংঘাত প্রতিরোধের লক্ষ্যে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলেছে।

কান্টের শান্তির দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি গভীর নৈতিক বাধ্যবাধকতা। তিনি যুক্তি দেন, শান্তি কেবল একটি বাস্তবসম্মত প্রয়োজনীয়তা নয়; বরং একটি নৈতিক কর্তব্য, যা প্রত্যেক মানবিকবাদী মানুষের অনুসরণ করা উচিত। শান্তির সন্ধান মানবতার সর্বোচ্চ নৈতিক আদর্শের একটি প্রকাশ, যা ন্যায়বিচার, স্বায়ত্তশাসনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সাধারণ কল্যাণের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। কান্টের মতে, চিরস্থায়ী শান্তি অর্জন হলো মানব অগ্রগতির চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং আমাদের নৈতিক সম্ভাবনার পরিপূর্ণতা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে যখন পারমানবিক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন বার্ট্রান্ড রাসেলের ও আইনস্টাইনের নেতৃত্বে জীবিত সব নোবেল লরিয়েটসহ অজস্র মানুষ যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনে প্রয়াসী হয়। আর বিংশ শতাব্দীর সাড়া জাগানো অর্থনীতিবিদ জে এম কেইন্স ভারসাই চুক্তিতে জার্মানিকে মাত্রারিক্ত শাস্তি দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি দলের প্রধান আলোচকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ‘দি ইকোনোমিক কনসিকুয়েন্সেজ অফ পিস’ লেখেন । উভয় ক্ষেত্রেই মূল সুর ছিল কান্টের শান্তিবাদের ধারণা। 

  • এন এন তরুণ অর্থনীতির অধ্যাপক, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@iub.edu.bd