সাগরে সৃষ্টি হওয়া কোনো নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস যথাযথ না হলে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসে চিড় ধরে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। চরম বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে এবারও হিমশিম খেতে হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের।
সোনাগাজীর সংবাদদাতা ফাঁকা আশ্রয়কেন্দ্রের ছবি পাঠিয়েছেন। জানিয়েছেন, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা বারবার মাইকিং ও অ্যালার্ম বাজিয়ে সতর্কবার্তা দিলেও সোনাগাজীর উপকূলবাসীরা আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চাইছেন না। স্বেচ্ছাসেবকেরা বলছেন, প্রবল ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে, এমন কথা তাঁরা বিশ্বাস করছেন না। সব ঝড়কে সাইক্লোন বললে ভবিষ্যতে এ রকম পরিস্থিতির ধারাবাহিকতা বাড়বে।
‘বড় দেরিতে তুমি বুঝলে’
কৃষকদের এই আশঙ্কার কথা আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয় বুঝতে পারে সোমবার, ২৪ তারিখে। ততক্ষণে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সোমবার বিকেলে মন্ত্রণালয়ে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় জরুরি প্রস্তুতিমূলক সভা বসে; সভা কৃষকদের কাছে আমন ধান কেটে ফেলার নির্দেশনা প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়। বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে মাঠের আমন ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ব হলেই কেটে ফেলতে হবে। পরে কৃষি মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সেটা প্রচার করে। এবারের আমন ধানের অবস্থা কৃষি মন্ত্রণালয়য়ের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। উত্তরের কিছু জেলা ছাড়া আমন এবার বৃষ্টির অভাবে দেরিতে লাগাতে হয়। দক্ষিণের জেলাগুলোতে এখনো ধানে ফুল আসতে বাকি।
এমন অবস্থায় মন্ত্রণালয় কেমন করে ৮০ শতাংশের হিসাব কষেন? তা ছাড়া কোনো ক্যারিশমায় যদি কোথাও ৮০ শতাংশ ধান পেকেও যায়, তাহলেও কি সেটা কাটার সময় সোমবার সন্ধ্যা হতে পারে? তবে ওই সভায় নেওয়া ১০টি সিদ্ধান্তের শেষের দুটি খুবই সঠিক আর কৃষিবান্ধব হতে পারে। সিদ্ধান্ত দুটি এ রকম—ক. উপকূলীয় এলাকায় ফসলের খেতে পানি ঢুকলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা। খ. স্লুইসগেট (জলকপাট) অপারেশনের মাধ্যমে লবণাক্ত পানি শস্যখেতে প্রবেশ রোধ ও অধিক উচ্চতায় জোয়ারের কারণে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে তা নিষ্কাশনের দ্রুত ব্যবস্থা করা।
উপকূলের অনেক অঞ্চলে জোয়ারের পানি ঢুকে গেছে। অমাবস্যা ও সূর্যগ্রহণের কারণে পানি নামতে সময় নেবে। পাথরঘাটার নতুন করা জলকপাটগুলো এতই সরু যে পানি এমনিতেই সরতে চায় না। এসব স্থানে একটু জোরেশোরে কাজে নামতে হবে। মন্ত্রণালয়ের জরুরি সভায় নেওয়া ৬ নম্বর সিদ্ধান্তটিও বিবেচনার দাবি রাখে। এখানে ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়েছে, যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কৃষকদের পুনর্বাসনের সহায়তা দেওয়া যায়। এখন আর জমির মালিকেরা চাষবাস করেন না, তাঁরা চাকরি, ব্যবসা, রাজনীতি করেন। অগ্রিম টাকা নিয়ে ভূমিহীনকে দেন চাষ করার দায়িত্ব। কিন্তু পুনর্বাসনের খাম চলে যায় জমির মালিকের কাছে। কৃষি পুনর্বাসনের লক্ষ্য হবে, ‘ক্ষতি যার, পুনর্বাসন তার’। অন্যথায় তেলে মাথায় তেল ঢেলে কৃষির কোনো উপকার হবে না।
এখন আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, আমরা ঠিক ঠাওর করতে পারিনি, বর্ণচোরা ছিল সিত্রাং; শুরু থেকেই সে এলোমেলো আচরণ করেছে। গতিপথ পাল্টেছে বারবার। ঠিকমতো বোঝা যায়নি। আসতে পথে বৃষ্টি ঝরিয়ে নিজের শক্তি ক্ষয় করেছে। যেমন চট করে এসেছে, তেমন চটজলদি চলে গেছে। স্কুল-কলেজ পাস না করা আবহাওয়াবিদেরা কিন্তু ঠিকই টের পেয়েছিলেন সিত্রাংয়ের মুরোদ
কতজন কীভাবে মারা গেলেন
কথিত ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সারা দেশে ঝরে গেছে ৩৫ জনের প্রাণ। এর মধ্যে আটজনের মৃত্যু হয়েছে গাছের চাপায়। ভুল জায়গায় ভুল গাছ লাগানো আর গাছের রক্ষণাবেক্ষণ না করার জন্যই এমনটি ঘটছে বারবার। বালু তোলা ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিক মারা গেছেন সন্দ্বীপ চ্যানেলে। তবে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির ছবি এখনো আসছে। লাশ গুনে দুর্যোগের ভয়াবহতা মাপার একটা মানসিকতা গড়ে উঠেছে। শিগগিরই কর্তারা বলবেন, এত বড় একটা সাইক্লোন গেল, মরল মাত্র ১১ জন। একজন মারা না গেলেও দুর্যোগ যে কত কঠিন হতে পারে, তা বলা বাহুল্য।
পূর্বাভাসের অঙ্ক মেলে না
মন্ত্রী বলেছিলেন, এটা হবে প্রবল ঘূর্ণিঝড়। এখন আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, আমরা ঠিক ঠাওর করতে পারিনি, বর্ণচোরা ছিল সিত্রাং; শুরু থেকেই সে এলোমেলো আচরণ করেছে। গতিপথ পাল্টেছে বারবার। ঠিকমতো বোঝা যায়নি। আসতে পথে বৃষ্টি ঝরিয়ে নিজের শক্তি ক্ষয় করেছে। যেমন চট করে এসেছে, তেমন চটজলদি চলে গেছে। স্কুল-কলেজ পাস না করা আবহাওয়াবিদেরা কিন্তু ঠিকই টের পেয়েছিলেন সিত্রাংয়ের মুরোদ।
শরণখোলা, পাথরঘাটা, চরফ্যাশন—যেখানেই ২৪ তারিখ সকালে যোগাযোগ হয়েছে, সব জায়গা থেকে একই উচ্চারণ শুনেছি, ‘বড় মিয়া (সিত্রাং) আসার আগেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে, আর ভয় নাই।’ সাইক্লোনের মাপ বোঝার এটা একটা তরিকা। স্থলভাগ গরম থাকলে সাইক্লোন তাকে ঠান্ডা করার জন্য ছুটে আসে, কিন্তু বৃষ্টির বাতাসে স্থলভাগ ঠান্ডা হয়ে গেলে সাইক্লোন আর জুত পায় না। মানুষের কাছে যে কত কিছু শেখার আছে!
উপকূল থেকে অনেক দূরে ঢাকার ক্ষতি কম নয়
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে বৃষ্টিতে ঢাকার প্রধান সড়কসহ অলিগলি তলিয়ে যায়। কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যায় একটি চারতলা বাড়ি হেলে পড়ে। বিডিআর ৫ নম্বর গেটের কাছে একটি বাড়ির দেয়াল ধসে চারজন আহত হয়েছেন। দুপুরের মধ্যেই বৃষ্টিতেই পুরান ঢাকার বংশালে রাস্তায় হাঁটুসমান পানি জমে যায়।
এরপর বিমানবন্দর সড়ক, মিরপুর, বসুন্ধরা, গুলশান, মহাখালী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় পানি জমে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হতে থাকে। গ্রিন রোড-সংলগ্ন সড়কে কোমরপানি হয়ে যায়। ব্যস্ততম সড়ক পান্থপথ সিগন্যাল থেকে গ্রিন রোডমুখী সড়কের পুরোটাই পানিতে তলিয়ে যায়। কাঁঠালবাগানের রেস্তোরাঁয়, জুরাইনের মসজিদে পানি ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শহীদ স্মৃতি হলের নিচতলার ডাইনিং বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। ফকিরাপুল মোড় থেকে নটর ডেম কলেজ পর্যন্ত সড়কটি রাত ১০টার পরও পানিতে তলিয়ে থাকে।
কাঁঠালবাগান, বেগম রোকেয়া সরণির কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ার অধিকাংশ বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে পড়ে। জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় কিছু কিছু ভবনের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখেন ভবনমালিকেরা। রাতে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বলা হয়, রাজধানীর হাতিরঝিল, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, গণভবনের সামনে, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, শ্যামপুর, নীলক্ষেতসহ ১৮টি স্থানে গাছ উপড়ে পড়ে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রাস্তা পরিষ্কারের চেষ্টা করেন প্রায় সারা রাত। গাছ পড়ে যাওয়ার কারণে রামপুরার উলনে বিদ্যুৎ সরবরাহকেন্দ্রের একটি গ্রিড বন্ধ করে দেওয়া হয়। রামপুরা থেকে বিকল্প উপায়ে লাইন চালু রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
কেন এমন হয়
সংবাদকর্মীরা জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খন্দকার মাহাবুব হোসেন বলেন, গাবতলী ও মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকার স্লুইসগেটগুলো হয়ে রাজধানীর বৃষ্টির পানি নামার কথা। নগরের পানি যেভাবে নেমে যাওয়ার কথা, সেভাবে নামতে পারছে না। ফলে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সিটি করপোরেশনের অনেকগুলো টিম জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছে।
তার মানে সমস্যা আমাদের জানা, কিন্তু কারও না কারও গাফিলতিতে এমন হচ্ছে। আগামী ঝড়বৃষ্টির আগে কি আমরা গাফিলতিকে ধরতে পারব?
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক। ইমেইল: [email protected]