চট্টগ্রামের পরিবেশের বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। শুধু পরিবেশবাদী নন, সাধারণ মানুষও চিন্তিত। নানা দিক থেকে দূষণের বিস্তার এবং তার কারণে সৃষ্ট সংকট জনজীবনে প্রভাব ফেলছে। নদী, বায়ু, পাহাড়, জলাশয়, মৃত্তিকা, শব্দ থেকে শুরু করে সবকিছু এখন দূষণের আওতায়। চট্টগ্রামে নতুন নতুন কায়দায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাশাপাশি কর্ণফুলী নদী ক্রমে ভরাট ও সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে বলেও স্থানীয় পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে চট্টগ্রাম ক্রমে বাসযোগ্যতা হারাবে।
কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জড়িত। ফলে এই দূষণ দেশের অর্থনীতিকেও বিপদগ্রস্ত করে তুলবে।
খবরে প্রকাশ, সংশ্লিষ্ট সবার চোখ এড়ানোর জন্য রাতে পাহাড় কাটা হচ্ছে। নতুন এই কৌশলে পাহাড়খেকোরা পুরোপুরি পাহাড়টাকে নিশ্চিহ্ন করছে না, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে মাটি কেটে সেখানে সমতল জায়গা সৃষ্টি করে তাতে সবজি চাষ করা হয়। এমনভাবে কাটা হয়, যাতে পাহাড়ের ভিতটা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তাতে বর্ষার দিনে টানা বৃষ্টিতে মাটি নরম হলেই যে পাহাড় ধসে পড়বে। আইনকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য পাহাড় কাটার এই পথটি বেছে নিয়েছে পাহাড়খেকোরা। মামলা, জরিমানা ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েও পাহাড়খেকোদের অপতৎপরতা থামানো যাচ্ছে না। তারা নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করছে। এসবের কারণে গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামের ১২০টি পাহাড় বিলুপ্ত হয়েছে।
গত কয়েক দশকে চট্টগ্রামে পাহাড়ের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় কীভাবে পাহাড়ি চট্টগ্রাম দ্রুত ধুলাবালির শহরে পরিণত হয়েছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নগরের পাঁচটি থানায় মোট ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাহাড়ের অবস্থান ছিল। নতুন শতকের প্রথম দশকে পাহাড়–অধ্যুষিত এলাকার আয়তন নেমে আসে ১৪ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটারে। ৩০ বছরে অর্ধেকেরও বেশি পাহাড় ‘নাই’ হয়ে গেল। এরপর আরো এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পাহাড় কাটা থামেনি। যে পাহাড়গুলো বর্তমানে চোখে পড়ে সেগুলো খণ্ডিত, কর্তিত। অনেকগুলো ধসের আশঙ্কায় রয়েছে।
পরিবেশ নিয়ে আরেকটি মন খারাপের খবর হলো কর্ণফুলীর খবর। কর্ণফুলীর ধারা দিন দিন ক্ষীণতর হচ্ছে। ৪০০ কোটি টাকা খরচ করে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং নিয়মিত ড্রেজিং করেও ভরাট হয়ে যাওয়া থামানো গেল না। শুধু গভীরতা কমছে না, প্রস্থও কমছে নদীটির। দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে সরু হয়ে উঠছে। চট্টগ্রাম নগরের কোটি মানুষ এবং শত শত কারখানার বর্জ্য, বিপুল পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রীর ভার আর বইতে পারছে না কর্ণফুলী। দখলমত্ত মানুষের জবরদখল, আর দূষণে মুমূর্ষু অবস্থার কারণে নদীর জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়ছে। এ দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরও হুমকির মুখে পড়েছে।
কর্ণফুলী নদীর শহর অঞ্চলে ফিরিঙ্গিবাজার ফেরিঘাট থেকে কর্ণফুলী শাহ আমানত ব্রিজ পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকা সবচেয়ে বেশি ভরাট ও দখলের কবলে পড়েছে। ২০২২ সালে একটি বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম কর্ণফুলীর তলদেশের গভীরতা ও দখল নিয়ে একটি জরিপ চালায়। সে বছর এপ্রিলে আধুনিক ফ্যাদোমিটারের মাধ্যমে ভাটার সময় নদীর তলদেশের গভীরতা পরিমাপ করা হয়।
এই পরিমাপে দেখা যায়, চাক্তাই খালের মোহনায় উত্তর পাশে কর্ণফুলীর প্রকৃত সীমানা থেকে ৩০০ ফুট নদীর অংশে গভীরতা মাত্র ২ ফুট। মাঝনদী বরাবর ১৩ দশমিক ৬ ফুট, দক্ষিণ পাড়ে তীরের কাছাকাছি গভীরতা ৪৮ ফুট। এর উজানে রাজাখালী খালের মোহনায় মাঝনদীতে গভীরতা মাত্র ৪ ফুট। এত কম গভীরতায় একটি নদীর ধারা চলতে পারে না। এর পাশাপাশি ২০১৪ সালে শাহ আমানত সেতু এলাকা ও চাক্তাই খালের মুখে কর্ণফুলীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯০০ মিটার। এখন নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ৪৩০ থেকে ৫১০ মিটারে। নদীর দুই পাড়েই বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে অবৈধ দখলদারিত্ব। নদী দখল করে তৈরি করা হয়েছে নানা স্থাপনা, অবকাঠামো। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে নদীর স্বাভাবিক গতিশীলতা ও প্রবাহ। যাতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের শঙ্কা যেমন জোরালো হচ্ছে, তেমনি নদীর কিছু অংশ মরে যাচ্ছে। নদীতীরে চর জেগে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তুলছে।
শুধু নদী ও পাহাড় নয়, চট্টগ্রামের খালগুলোর অবস্থাও সংকটাপন্ন। সব খাল ময়লা–আবর্জনাবাহিত নর্দমায় পরিণত হয়েছে। শহরের কেন্দ্রের খালগুলো থেকে আবর্জনার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাতাস দূষিত করে। প্লাস্টিক আর পলিথিন মাটি, খাল ও নদীকে ধ্বংস করছে। উন্নয়ন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য সবুজ বিলীন হয়েছে। অতিরিক্ত গভীর নলকূপ বসানোর কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাচ্ছে। ফলে মরুময়তায় আক্রান্ত হচ্ছে মাটি। ভবিষ্যতে ভূগর্ভে পানিসংকট দেখা দিলে ভূমিকম্পের মতো নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপর্যয় ডেকে আনবে।
চট্টগ্রামের বায়ুদূষণও বিপৎসীমার মধ্যে রয়েছে। দিনের বেলা শব্দদূষণ মানুষের সহ্যসীমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। দূষিত হচ্ছে বায়ু। ধ্বংস হচ্ছে গাছপালা, অরণ্য। মুছে ফেলা হচ্ছে পুকুর–দিঘি। খাদ্যে মেশানো হচ্ছে বিষ। সব মিলিয়ে চারদিকের নানা দূষণ এই শহরের মানুষদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করছে। মানুষ এ নিয়ে বড় চিন্তিত। সত্যিকার অর্থে পরিবেশের বড় বড় সংকট, বিশেষ করে পাহাড়ধস, নদী ও খালদূষণ এবং বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণ কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী লোভী মানুষ।
চট্টগ্রাম শহরের ৯৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ খাল–নদী দখল, পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল ধ্বংসের জন্য দায়ী নয়। মাত্র কয়েক শতাংশ মানুষের লোভের কাছে জিম্মি হয়ে আছে এ শহরের মানুষ। এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। পরিবেশের এই বিপর্যয় মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে দূষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। দেশের পরিবেশ বাঁচাতে এখন তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে বেশি। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি একটি পরিবেশবাদী আন্দোলন।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক