ক্ষমতা না থাকলে আম-ছালা দুটিই যে যায়

আমরা দাঁত থাকতে কেউ দাঁতের মর্যাদা দিই না। তবে অযত্নে এবং অবহেলায় দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত, নষ্ট বা পড়ে যাওয়ার পর দাঁতের গুরুত্ব বুঝতে পারি। তখন আমাদের আফসোস করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

বাকি জীবন বিনা দাঁত বা নকল দাঁত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। সুস্থ থাকতে কেউ আমরা স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝি না। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বিছানাতেই কেবল আমরা স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝি। অর্থাৎ হাসপাতালের বিছানাতেই কেবল বুঝতে পারি ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মানুষের মূল’।

আবার আমরা জীবন থাকতে কেউ জীবনের মর্যাদা দিই না। তাই জীবনসায়াহ্নে এসে কবি কায়কোবাদের মতো হয়তো আফসোস করে বলি, ‘যে ভুলে তোমারে ভুলে—হীরা ফেলে কাচ তুলে।/ ভিখারি সেজেছি আমি,/ আমার সে ভুল প্রভু তুমি ভেঙে দাও ।/ প্রভু ভুল ভেঙে দাও ।’

ক্ষমতা পেলেও আমরা ক্ষমতার যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজ দপ্তর কিংবা দেশের মঙ্গলসাধনে ব্যস্ত থাকার মাধ্যমে ক্ষমতার মর্যাদা দিই না। বরং নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বেচ্চাচারিতা বা ক্ষমতার অপব্যবহারে সর্বদা ব্যস্ত থাকি । ক্ষমতার দাপটে তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করি।

এ দৌড়ে গৃহকর্মী থেকে শুরু করে মনিব, পাইক-পেয়াদা, সৈন্য-সামন্ত, নাজির-উজির কিংবা রাজা-বাদশাহ কেউ পিছিয়ে নেই। আবার  ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ কোনো  পেশাজীবীও বাদ নেই।

তবে মরিচের মতো পদমর্যাদায় যার অবস্থান যত ছোট, ক্ষমতা পেলে তার ঝাঁজ তত বেশি হয়। গৃহকর্মী, গাড়িচালক, নিরাপত্তা প্রহরী, অফিস সহায়ক, সাধারণ রাজকর্মচারী কিংবা কোনো সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীর কাছে কিছু ক্ষমতা অর্পণ করে দেখুন তাদের ক্ষমতার ঝাঁজ কতটুকু।

ক্ষমতার অপব্যবহার আমাদের জাতীয়  সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।

পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা  সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ পড়তেই দেখা যায় ক্ষমতাধারীদের কেউ চিবিয়ে চিবিয়ে নদী খাচ্ছে, কেউ খালবিল ও জলাশয় খাচ্ছে, কেউ পাহাড়-পর্বত খাচ্ছে, কেউ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় খাচ্ছে, কেউ ব্যাংক খাচ্ছে, আবার কেউ আস্ত দেশটাই  গিলে খাচ্ছে।

ক্ষমতায় বসার আগে যাদের ফেরেশতা ভাবা হয়, ক্ষমতার বসতেই তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে কামড় বসাচ্ছে। আর যে যত ক্ষমতাবান, তার কামড় তত বড় এবং বিষও তত বেশি। তাদের কামড়ে দেশ আজ রক্তাক্ত, মানচিত্র ক্ষতবিক্ষত।

ক্ষমতাধারীদের এসব বিষয় জানা থাকলেও তা মানার কোনো তাড়না থাকে না। কেননা ক্ষমতার দম্ভ ও অহংকার তাদের চোখ অন্ধ করে দেয় । তবু ক্ষমতাধারীদের বলব, ক্ষমতা থাকতে ক্ষমতার দম্ভ ও অহংকারের অন্ধত্বের পর্দা সরিয়ে ফেলে দেখুন মানুষ কত কষ্টে আছে।

তাদের করুণ আর্তনাদ ক্ষমতাসীনদের কৃষ্ণগহ্বরে পৌঁছাচ্ছে না। কারণ, তারা অন্ধ ও বধির হয়ে গেছে। এসব নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত মানুষের সারি ক্রমেই লম্বা হচ্ছে।

তবে যৌবন বা নদীর জোয়ারের মতো আমাদের ক্ষমতা একসময় চলে যায়। তখন বড় আফসোস হয়। তখন ভাবি কোনটা করা উচিত ছিল আর কোনটা করা টিক হয়নি। কিন্তু দাঁত পড়ে যাওয়ার মতো এ ভাবনাও কোনো ফল দেয় না।

বরং ক্ষমতা থেকে পতনের পর  অত্যাচারীরা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত  হয় এবং তারা সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ ও একা হয়ে যায়। তখন  তার কাছ থেকে সুবিধাভোগী তোষামোদি চক্র এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের  মদদদাতারা  তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে। আবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশে-বিদেশে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তোলে, তা তার কোনো কাজে আসে না।

একদিকে নিঃসঙ্গতা, রোগশোক এবং অনুশোচনা, অন্যদিকে ক্ষমতায় থাকাকালীন চরম ভোগবিলাসিতায় কাটানোর পর জনগণের ঘৃণা-অপমান এবং কটূক্তি থেকে বাঁচার জন্য তাদেরকে জনমানবহীন আশ্রয়স্থল খুঁজতে হয়। দেশ-বিদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ পাওয়া যাবে।  

ক্ষমতা না থাকলে যে আম-ছালা দুটিই যায় তার প্রমাণ তো দেশের ইদানীং কালের কিছু ঘটনাপ্রবাহ থেকে সহজে অনুমেয়। এ সব  প্রতাপশালী ব্যক্তিদের টিকি কখনো স্পর্শ করা যাবে তা সাধারণ মানুষের ধারণাতেই ছিল না। কিন্তু, কথায় বলে ‘পাপের ষোলো-কলা পূর্ণ হলে কেউ রেহাই পায় না’।

এটি পুরোপুরি সত্য কথা। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে ষোলো-কলা পূর্ণ হতে একটু বেশি সময় লাগে। তখন তারা ভাবতে থাকে এত পাপ করছি তাতে কোনো শাস্তি আসছে না। ফলে তাদের পাপের মাত্রা বেড়ে যায় এবং এক সময় তা ষোলো-কলা পূর্ণ হয়।

মনে রাখা দরকার, দাঁত, স্বাস্থ্য, কিংবা জীবন নষ্ট হলে তার ফল মূলত নিজেকেই ভোগ করতে হয়। তাই এর ব্যাপ্তি কেবল ব্যক্তিগত যন্ত্রণা এবং অনুশোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ  থাকে। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহারে  প্রতিষ্ঠান, কোনো অঞ্চল, পুরো দেশ কিংবা সমগ্র বিশ্ব  ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ক্ষমতাধারীদের এসব বিষয় জানা থাকলেও তা মানার কোনো তাড়না থাকে না। কেননা ক্ষমতার দম্ভ ও অহংকার তাদের চোখ অন্ধ করে দেয় । তবু ক্ষমতাধারীদের বলব, ক্ষমতা থাকতে ক্ষমতার দম্ভ ও অহংকারের অন্ধত্বের পর্দা সরিয়ে ফেলে দেখুন মানুষ কত কষ্টে আছে।

তোষামোদি চক্রের ব্যূহ ভেদ করে শাসকের দৃষ্টির পরিবর্তে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে দেখুন তাহলে জনগণের দুঃখ-যাতনা, গঞ্জনা-বঞ্চনা এবং কষ্ট বুঝতে পারবেন। আর সেই কষ্ট নিবারণ করে ক্ষমতার প্রকৃত মর্যাদা দিন। তাহলে ক্ষমতা হারালেও জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে উপযুক্ত সম্মানসহ বীরত্বপূর্ণ জীবন কাটাতে পারবেন। আর না হলে ইতিহাসের বইয়ে স্থান পাওয়া ক্ষমতাচ্যুত ব্যক্তিদের মতো করুণ দশা বরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
 
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।