বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলন করে আসলে কী চেয়েছেন

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশন স্কিম আগামী বছর চালু হবে বলে জানিয়েছে সরকার। শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে লিখেছেন তারিক মনজুর

প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোঘণা দিয়েছেনছবি : প্রথম আলো

এবারের শিক্ষক আন্দোলন নিয়ে নানা রকম মন্তব্য এসেছে। এমন মন্তব্যও এসেছে—শিক্ষকদের এই আন্দোলন ‘ট্রেড ইউনিয়ন’ ধরনের, যেখানে কেবল নিজেদের সুযোগ-সুবিধার কথাই উচ্চারিত হয়েছে। সামগ্রিক পেনশন–ব্যবস্থার বৈষম্য ও প্রয়োজনের কথা তাঁদের দাবিতে উঠে আসেনি। বিভিন্ন আলোচনায় ও লেখালেখিতে শিক্ষকেরা হিসাব কষে দেখিয়েছেন, তাঁরা কীভাবে প্রত্যয় পেনশন স্কিমে বঞ্চিত হবেন। কিন্তু প্রত্যয়সহ অন্য স্কিমগুলোকে অধিকতর যৌক্তিক ও কার্যকর করার কোনো সুপারিশ তাঁরা করেননি।

শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে কখনোই খুব বেশি চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হয়নি। কেউ কেউ বলেছেন, শিক্ষক-নেতাদের বেশির ভাগই যখন আওয়ামীপন্থী, তখন সুরাহা জটিল হবে না! তবে যৌক্তিক সমাধানের আগে ধানমন্ডির দলীয় কার্যালয়ে এত দ্রুত ‘ভুল–বোঝাবুঝি’র অবসান হবে, এটা হয়তো সাধারণ শিক্ষকেরাও ভাবতে পারেননি।

শিক্ষকদের সর্বাত্মক আন্দোলনের পর থেকে সরকার নিশ্চয় এর সমাধান খুঁজেছে। ৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে শিক্ষক-নেতাদের সম্ভাব্য বৈঠকের খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। যদিও সে বৈঠক হয়নি। অনুমান করা যায়, কোনো রকম ‘হোমওয়ার্ক’ না করে সরকারের তরফ থেকে আলোচনায় বসার ব্যাপারে অনাগ্রহ ছিল। তা ছাড়া সরকারও এমন সমাধান খুঁজেছে, যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের পেনশন স্কিমগুলো ‘চাপিয়ে’ দেওয়ার বিপরীতে কোনো প্রতিষ্ঠান বা পেশাজীবী সংগঠন আপত্তি না করে। ফলে শিক্ষকদের ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা থেকে সরকার এগিয়েছে।

আপাতভাবে মনে হচ্ছে, সরকারের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে শিক্ষকদের হিসাব-নিকাশ প্রায় ব্যর্থ হতে চলেছে। কারণ, ১৩ জুলাই বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘ভুল–বোঝাবুঝি মিটেছে। শিক্ষকদের সর্বজনীন পেনশন স্কিম আগামী বছর চালু হবে।’ শিক্ষকেরা নিশ্চয় আগামী বছর থেকে পেনশন স্কিম চালু করার জন্য আন্দোলন করেননি।

আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পাঁচ সদস্যের কমিটি বিদ্যমান ও নতুন পেনশন–ব্যবস্থার একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেছেন, যেটি যথার্থ নয়। হিসাবে দেখানো হয়েছে, বর্তমানে একজন অধ্যাপক অবসরে গেলে গ্র্যাচুইটি বাবদ এককালীন ৮০ লাখ টাকার বেশি পান। আর নতুন স্কিমে সেটি নেই। আবার বেতন থেকে টাকা না কেটেও অধ্যাপকেরা পান মাসিক ৪৫ হাজার টাকার ওপরে। আর নতুন স্কিমে সেটি দাঁড়াবে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকার মতো। আরও অনেক ক্ষেত্রেই সুবিধার ঘাটতি দেখানো হয়েছে। কিন্তু নতুন স্কিম কতটুকু অবিবেচনার ফল, তা এই তুলনা থেকে মোটেও স্পষ্ট হয় না।

খেয়াল করা দরকার, এখানে একটি হিসাব বর্তমানের, আর অন্য হিসাবটি ৩০ বছর পরের। তা–ও মাসিক ১০ হাজার টাকা করে চাঁদার ভিত্তিতে। ৩০ বছর পরে পাওয়া সোয়া লাখ টাকার মান আসলে কী দাঁড়াবে? টাকার অবমূল্যায়ন গড়ে ৬ শতাংশ ধরলে ওই টাকার মান হবে বর্তমানের ২১ হাজার টাকার সমান বা কাছাকাছি। অবশ্য একই সঙ্গে জমা দেওয়া টাকারও অবমূল্যায়ন হবে। তবে এটা বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়, নতুন স্কিমের মাসিক পেনশন দিয়ে জীবন চালানো কতটা অসম্ভবপ্রায় হবে। অন্যান্য স্কিমে যাঁরা এক থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে পেনশন পাওয়ার আশা করছেন, তাঁদের অবস্থা আর না বলাই ভালো।

সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, আর্থিক সুরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে পেনশন স্কিমগুলো চালু করা হয়েছে। কিন্তু আদৌ কি তা অবসরকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করবে?

শিক্ষকদের আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, আগামী বছর ১ জুলাই থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হবেন। এটি নিশ্চিত হলে তাঁদের মধ্যেও আতঙ্ক ভর করার কথা। কারণ, প্রত্যয়সহ বর্তমানে চালু পাঁচটি পেনশন স্কিমের মূল কাঠামোয় কোনো পার্থক্য নেই। অতএব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নিশ্চয় অভিনব কোনো স্কিম প্রস্তাব করা হবে না।

‘সর্বজনীন’ শব্দের অর্থ—যা সবার জন্য মঙ্গলকর। কিন্তু চাঁদা প্রদান ও পেনশন প্রাপ্তির হিসাব থেকে বোঝা যায়, এসব স্কিম অবসরকালীন আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না। বরং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভেবে মানুষের মধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রবণতা আরও বেড়ে যেতে পারে। সেটি নিশ্চয় মঙ্গলকর হবে না। এরপরও পেনশন স্কিমগুলো চালু করার ব্যাপারে সরকারের ব্যাপক আগ্রহ থেকে বোঝা যাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত কোনো প্রতিষ্ঠানের কেউই হয়তো সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি থেকে ‘রেহাই’ পাবেন না। যদি বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে বিভিন্ন স্কিমের আওতায় আনতেই হয়, তবে একে সর্বজনীন না বলে ‘বাধ্যতামূলক পেনশন স্কিম’ বলুন।

  • তারিক মনজুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।