পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পথচলায় একটা বড় রকমের বাঁকবদল হয়েছিল। আমরা অনেকেই এটাকে সামরিক বাহিনীর মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিপরীতে সামরিক বাহিনীর উত্থান হিসেবে দেখি। তবে এটা বলতেই হয়, ওই দিনটিতে বাংলাদেশ রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে গিয়েছিল।
যেকোনো ঘটনার পক্ষ-বিপক্ষ থাকে। যে পক্ষ জয় পায়, তাদের কাছে এটি হলো একটি পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন। যে পক্ষ হেরে যায় বা নিজেকে মনে করে ভিকটিম, তারা বিষয়টিকে দেখে ষড়যন্ত্র হিসেবে। ঘটনা কিন্তু একটাই। মুদ্রার এক পিঠে পরিকল্পনা, অন্য পিঠে ষড়যন্ত্র। এ দেশে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির যে স্থায়ী বিভাজন তৈরি হয়েছে, তাতে এই প্রশ্নের সুরাহা হওয়ার সুযোগ নেই। প্রত্যেক পক্ষের ঝুলিতে আছে নানান যুক্তি। প্রতিবছর ৭ নভেম্বর আসে। তখন তারা ওই যুক্তিগুলো নিজ নিজ ঝুলি থেকে বের করে।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। ধরা যাক কয়েকজন লোক মিলে গোপনে একটা সভা করে ঠিক করল, চলো আমরা ক্ষমতা দখল করে ফেলি। ষড়যন্ত্র কি এভাবে হয়? চাইলেই কি কেউ ইচ্ছেমতো কিছু করে ফেলতে পারে? আমার তা মনে হয় না। যেকোনো ঘটনার একটা প্রেক্ষাপট থাকে। সেটি তৈরি হলে তখন ঘটনাটি ঘটে যায়। অর্থাৎ একটি কিছু করার শর্ত তৈরি হয়।
লিফলেট লিখে আর পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু শর্ত তৈরি হলো কখন, যখন ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন শুরু করল। তখন যুদ্ধ করা ছাড়া উপায় ছিল না। বাঙালি যুদ্ধ চায়নি। যুদ্ধটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাঙালি তখন প্রতিরোধে নেমেছে।
একাত্তরের প্রসঙ্গ যখন উঠলই, তখন একটি কথা বলা দরকার। প্রথম প্রতিরোধ করেছিল পুলিশ, ইপিআর আর সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের একটি অংশ। প্রতিরোধযুদ্ধ চলেছেও কিছুদিন, বিশেষ করে কুষ্টিয়া আর চট্টগ্রামে। এই প্রতিরোধ বেশি দিন টেকেনি। প্রতিরোধযোদ্ধারা পিছু হটতে হটতে একসময় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান এবং সেখান থেকে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখেন।
দেশে যখন চরম সংকট আর অনিশ্চয়তা, তখন রাজনীতিবিদেরা যে যাঁর মতো আত্মগোপনে বা ভারতে চলে যান। সাত কোটি মানুষের পক্ষে দেশান্তরী হওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁরা থেকে গেলেন একটা মহাবিপদের মুখে। ঠিক ওই সময় কয়েকজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা একসঙ্গে বসেন তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে। দিনটা ছিল ৪ এপ্রিল।
তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। তাঁরা কর্নেল (পরে জেনারেল) ওসমানীকে নেতা মেনে নেন এবং একটি রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন অনুভব করেন। প্রায় এক সপ্তাহ পরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার খবর জানা যায়। সুতরাং বলা চলে, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক নেতৃত্বের আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সামরিক নেতৃত্ব। এই যে ঝুঁকি তাঁরা নিলেন, তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো প্রণোদনা ছিল। সেটা ছিল দেশপ্রেম।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর অংশীদারত্ব নিয়ে প্রকাশ্যে সোচ্চার হন পরবর্তী সেনাপতি। এই মডেল আমরা দেখেছি নানান দেশে—ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক ও মিসরে। মনে হয়, সবাই এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। একে কেউ আর এড়িয়ে যেতে বা উপেক্ষা করতে পারছে না। উপনিবেশ–উত্তর অনেক দেশেই নাজুক গণতন্ত্র আর ভঙ্গুর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে এই প্রক্রিয়া জারি থাকছে।
অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করা। বিপদ আঁচ করতে পেরেই তাঁরা বিদ্রোহ করেন। তাঁরা মরার ভয়ে জান বাঁচাতে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন, এমন একটা কথা রটিয়ে তাঁদের কেউ কেউ খাটো করে দেখেন। অনেক সৈনিক তো যুদ্ধ করেননি। তা ছাড়া জান বাঁচাতে রাজনীতিবিদেরা অনেকেই অসহায় জনগণকে ফেলে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। কেউ একা, কেউ সপরিবার।
সেই থেকে রণাঙ্গনের সৈনিকেরা মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ভূমিকাকে গৌরবের চোখে দেখেন। তাঁরা মনে করেন, তাঁরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। কিন্তু তাঁরা রয়ে গেছেন অপাঙ্ক্তেয়। মুক্তিযুদ্ধের একক মালিকানা দাবি করেছেন রাজনীতিবিদেরা। দ্বন্দ্বের শুরু সেখান থেকেই। তাই পঁচাত্তরের তিনটি অভ্যুত্থানের সুলুক-সন্ধান করতে হলে যেতে হবে একাত্তরে। একাত্তরেই রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল সৈনিকদের মনে। পরে এই ধারণা নানা কারণে আরও শক্ত হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা না করে বরং কেউ কেউ এটা আরও উসকে দিয়েছেন। এখানে ভারত ফ্যাক্টর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্যের মনে হয়েছিল যে ভারতের ‘তাঁবেদারি’ করার জন্য বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে ইচ্ছা করে দুর্বল রাখা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা তৈরি হয়, তাঁরা যখন জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করছেন, তখন রাজনীতিবিদেরা কলকাতায় নিরাপদে দিন কাটিয়েছেন।
যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি রাজনৈতিক সরকার। সেই সরকারের বিরুদ্ধে নানা কারণে জনবিক্ষোভ ছিল। ওই সময়ের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ ১৯৯৩ সালে ভোরের কাগজ সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তখন সরকারের কিছু কার্যকলাপ জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল।
আবার সেনাবাহিনীর মধ্যেও অসন্তোষ ছিল।… সেনাবাহিনীর সদস্যদের এ রকম মনোভাব ছিল যে তাঁরা কিছুটা অবহেলিত। যদিও ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্য ছিল না। তবে কতকগুলো কার্যকলাপ, যেমন রক্ষীবাহিনীর আবির্ভাবটা অসন্তোষের একটা বড় কারণ ছিল। … দেশের তৎকালীন অবস্থায়, যেমন ‘বাকশাল’ গঠন ইত্যাদি নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া ছিল। আমার মধ্যেও কিছু প্রশ্ন ছিল। সেগুলো নিয়ে আমি কথা বলেছিলাম।’
আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, ক্ষমতাসীন দলের বাইরে বেশ কিছু দল সরকার পরিবর্তন চেয়েছিল। তারা সরকার ‘উৎখাতের’ কথা বলত। তাদের মনে হয়েছিল, নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সরকার পরিবর্তনের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে ‘বাকশাল’ তৈরির মধ্য দিয়ে। তখন প্রশ্ন আসে ‘উৎখাতের’।
এর অর্থই হলো ‘ভায়োলেন্স’। কয়েকটি দল সরাসরি সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমে পড়ে। একদিকে জন-অসন্তোষ, সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস, সব দলের (আওয়ামী লীগ-বাকশাল ছাড়া) সরকার উৎখাতের আহ্বান এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে দলাদলি—এসব মিলে তৈরি হয় পরিবর্তনের শর্ত। আওয়ামী লীগে সংহতি থাকলে অন্যরা কিছু করতে পারত না। অভ্যন্তরীণ শর্ত তৈরি হলেই বাইরে থেকে সুযোগসন্ধানীরা ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে। এই পটভূমিতে ১৫ আগস্ট ঘটে গেল রক্তাক্ত পালাবদল। একদিকে অভ্যুত্থান, অন্যদিকে নৃশংস হত্যাকাণ্ড। পুরো সামরিক বাহিনী সেটা মেনে নিল।
১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর একটি গ্রুপ অভ্যুত্থান ঘটায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি অংশ তাকে সমর্থন দেয়। এমনও বলা যায়, আওয়ামী লীগের একটি অংশকে হটিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আরেকটি অংশ ক্ষমতা দখল করে। যেসব দল এত দিন মাঠে সরকার উৎখাতের আওয়াজ দিচ্ছিল, তাদের কপালে কিছু জোটেনি। সেনাবাহিনীর মধ্যেও সংহতি ছিল না।
একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারা অনেকেই বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। তাঁদের অন্য একটি গ্রুপ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায় ৩ নভেম্বর। আওয়ামী লীগের অনেকেই ভেবেছিলেন, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান বুঝি তাঁদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য হয়েছে। এই ডামাডোলে ঘটানো হলো বর্বরোচিত জেলহত্যা। নতুন সেনানায়ক এসে জাতীয় সংসদ বাতিল করে দেন। রাজনীতির সামরিকীকরণের প্রক্রিয়াটি আরও বেগবান হয়। সামরিক বাহিনীতে এবং মানুষের মধ্যে সমর্থনের অভাবে তিন দিনের মাথায় অভ্যুত্থানকারীদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। ৭ নভেম্বর ঘটে আরেকটি অভ্যুত্থান।
তিনটি অভ্যুত্থানেই সেনানেতৃত্বের মধ্যে নানা রকম সমীকরণ দেখা গেছে। ১৫ আগস্টের ব্যাপারে সবাই মোটামুটি একমত ছিলেন। কেউ অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেন, কেউবা চুপচাপ বসে থাকেন। ৩ নভেম্বর সমীকরণ পাল্টে যায়। ৭ নভেম্বর তৈরি হয় অন্য রকম সমীকরণ।
১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনী ক্ষমতার বারান্দায় ঢুকে পড়েছিল। ৭ নভেম্বর তারা ক্ষমতার একেবারে অন্দরমহলে ঢুকে যায়। যে ‘সিভিল মিলিটারি’ দ্বন্দ্ব একাত্তরে শুরু হয়েছিল, ৭ নভেম্বরে এসে তার একপ্রকার নিষ্পত্তি হয়। সামরিক বাহিনীর যে রাজনীতিকীকরণ শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে, ১৯৭৫ সালে এসে তা পরিপক্ব হয়। তাদের উত্থান ঘটে রাষ্ট্রক্ষমতার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। তারা নিজেদের সবচেয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর অংশীদারত্ব নিয়ে প্রকাশ্যে সোচ্চার হন পরবর্তী সেনাপতি। এই মডেল আমরা দেখেছি নানান দেশে—ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক ও মিসরে। মনে হয়, সবাই এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। একে কেউ আর এড়িয়ে যেতে বা উপেক্ষা করতে পারছে না। উপনিবেশ–উত্তর অনেক দেশেই নাজুক গণতন্ত্র আর ভঙ্গুর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কারণে এই প্রক্রিয়া জারি থাকছে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক