নারীর পোশাক কেমন হওয়া উচিত?

পোশাকের বৈচিত্র্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি
ফাইল ছবি

গত বছর মে মাসে নরসিংদী থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে স্টেশনে অপেক্ষারত এক তরুণীকে হেনস্থার ঘটনা আমাদের অনেকেরই মনে থাকতে পারে। এই ঘটনার মূল হোতা স্থানীয় এক মধ্যবয়স্ক নারী। স্টেশনে অনেক মানুষের উপস্থিতিতে তিনি অভিযোগ করেন যে তরুণীর পোশাক অশালীন। এই বিষয়ে বাদানুবাদ শুরুর একপর্যায়ে তিনি তরুণীটিকে প্রথমে মৌখিক এবং পরে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেন। ওই নারীকে সেখানে উপস্থিত থাকা আরও কিছু পুরুষ সমর্থন দেন। ঘটনাটি খুব দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক দিন ধরেই এই বিষয়ে দেশজুড়ে পক্ষে–বিপক্ষে নানা প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে।

এই ঘটনা নিয়ে আদালতে মামলা হলে র‌্যাব অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে। উচ্চ আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জামিনের শুনানিতে বাদীপক্ষের আইনজীবী ব্যক্তির নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরার অধিকারের কথা উল্লেখ করেন। সে প্রসঙ্গে উচ্চ আদালত প্রশ্ন করেন, ‘(ওই তরুণী) প্ল্যাটফর্মে আপত্তিকর অবস্থায় ছিল, সিডিতে দেখা যায়। এটি আপনার অধিকার? পোশাকের অধিকার?’ আদালত প্রশ্ন করেন, ‘কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার অধিকার মানুষের নেই? পোশাক সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না? যে সমাজে যাবেন, সে সমাজের আর্থসামাজিক অবস্থাও একটি বিষয়। ঢাকায় একধরনের পরিবেশ, গ্রামে অন্য ধরনের’ (দৈনিক প্রথম আলো, ১৭ আগস্ট ২০২২)।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলো আদালতের এই বক্তব্যের সমালোচনা করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র এক বিবৃতিতে উল্লেখ করে, ‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে মহামান্য উচ্চ আদালতের বক্তব্য যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তা যদি সত্য হয়, তবে তা নারীর সম-অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারের মানদণ্ড এবং বর্তমান সরকারের নারীর ক্ষমতায়নসংক্রান্ত নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়’ (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ১৭ আগস্ট ২০২২)।

জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে নিম্ন আয়ের লোকেরা যেখানে অশালীন পোশাককে বেশি আপত্তিকর মনে করছেন, ঠিক একইভাবে উচ্চ আয়ের লোকদের চোখে বিদেশি পোশাক বেশি আপত্তিকর মনে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে মতামতে তেমন কোনো ভিন্নতা দেখা যায়নি। তবে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে ‘অশালীন’ পোশাকের প্রতি একটু বেশি বৈরী মানসিকতা লক্ষ করা যায়।

এদিকে আদালতের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী মানববন্ধন করেন। তাঁদের অনেকেই ‘পোশাকের স্বাধীনতার নামে পাবলিক নুইসেন্স বন্ধ করার দাবি’ এবং ‘দেশীয় মূল্যবোধ বিরোধী সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে বক্তব্য তুলে ধরেন।

নরসিংদীর ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই বিতর্ক আমাদের এই বিষয়ে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধ সম্পর্কে ভাবতে আগ্রহী করে তোলে। এই মূল্যবোধগুলো আসলে কেমন? অনুমাননির্ভর কোনো বক্তব্য না দিয়ে তাই আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিত্বশীল জরিপের মাধ্যমে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। এতে অংশ নেন ১০ হাজার ২১৮ জন প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি নাগরিক। উত্তরদাতাদের মধ্যে নারী-পুরুষের অনুপাত ছিল সমান। তাঁদের আমরা জিজ্ঞাসা করি, ‘নারীরা নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরতে পারে’—এই বক্তব্যের সঙ্গে কি আপনি একমত?

জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৪০ জন বাংলাদেশি নাগরিক এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন, দ্বিমত করেন শতকরা ৬০ জন। পুরুষ উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ৩২ শতাংশ এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন, নারীদের ক্ষেত্রে যা ৪৯ শতাংশ। গ্রামে বা শহরের উত্তরদাতাদের মধ্যে তেমন কোনো তফাত ছিল না। তবে অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে একমতের হার বয়স্কদের তুলনায় সামান্য বেশি ছিল। উত্তরদাতাদের আয় অনুযায়ী ভাগ করলেও মতামতে খুব বেশি পার্থক্য দেখা যায়নি। কিন্ত সবচেয়ে বেশি মাসিক আয় যাঁদের, তাঁদের উত্তর অন্যদের থেকে সামান্য আলাদা ছিল।

উদাহরণস্বরূপ, যাঁদের মাসিক আয় ৫০০০ থেকে শুরু করে ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত, তাঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশ লোক এই বক্তব্যে একমত প্রকাশ করেন। তবে যাঁদের মাসিক আয় ৫০ হাজার টাকা বা তার বেশি, তাঁদের মধ্যে একমত প্রকাশ করেন ৩০ শতাংশ। একইভাবে, উত্তরদাতাদের মধ্যে যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক বা তার কম, তাঁদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মানুষ একমত প্রকাশ করেন। যাঁরা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন, তাঁদের মধ্যে একমত প্রকাশের হার ৩৬ শতাংশ।

‘নারীরা নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরতে পারে’—এ কথার সঙ্গে যাঁরা (৬০ ভাগ অংশগ্রহণকারী) একমত নন বলে মত প্রকাশ করেছেন, তাঁদেরকে পরবর্তী সময় প্রশ্ন করা হয় নারীদের কোন ধরনের পোশাক তাঁদের কাছে আপত্তিকর বলে মনে হয়। এর উত্তরে অধিকাংশই প্রথমে উল্লেখ করেছেন পাশ্চাত্য পোশাকের কথা (৫৩ শতাংশ)। নারীদের মধ্যে পাশ্চাত্য পোশাকের প্রতি আপত্তি বেশি (৫৭ শতাংশ)। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৪৪ শতাংশ। আপত্তিকর বলতে ৪১ শতাংশ উত্তরদাতা বুঝিয়েছেন ‘অশালীন পোশাক’। অশালীন পোশাক বলতে তাঁরা হাতকাটা, খাটো, আঁটসাঁট বা শরীর দেখা যায় এমন পোশাককে বুঝিয়েছেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ বোরকা বা হিজাব না পরাকে আপত্তিকর বলেন। দেশি বা উপমহাদেশের পোশাককে আপত্তিকর বলে মনে করার সংখ্যাও খুবই নগণ্য, ১ শতাংশের কম।

আরও পড়ুন

জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে নিম্ন আয়ের লোকেরা যেখানে অশালীন পোশাককে বেশি আপত্তিকর মনে করছেন, ঠিক একইভাবে উচ্চ আয়ের লোকদের চোখে বিদেশি পোশাক বেশি আপত্তিকর মনে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে মতামতে তেমন কোনো ভিন্নতা দেখা যায়নি। তবে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে ‘অশালীন’ পোশাকের প্রতি একটু বেশি বৈরী মানসিকতা লক্ষ করা যায়।

এই জরিপ থেকে বাংলাদেশে নারীদের পোশাকসংক্রান্ত সামাজিক মূল্যবোধের কেমন চিত্র আমরা দেখতে পাই?

প্রথমত, পোশাকের ব্যাপারে সামাজিক বিশ্বাস কিংবা মূল্যবোধের ভূমিকা সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অর্থাৎ এই মূল্যবোধগুলো শ্রেণি, গোষ্ঠী, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অর্থনৈতিক অবস্থা, লিঙ্গ, বয়স বা আবাসস্থল নির্বিশেষে সব উত্তরদাতাই ধারণ করেন। এর কারণ কী? প্রচারমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক) এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর বদৌলতে পোশাকসংক্রান্ত মূল্যবোধগুলো কি কোনো বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠীতে আবদ্ধ না থেকে সবার কাছে ছড়িয়ে যাচ্ছে? আমরা সামাজিক মূল্যবোধের একটা সমমাত্রিকতা দেখতে পাচ্ছি?

আরও পড়ুন

দ্বিতীয়ত, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি (পাশ্চাত্য বিরোধিতা) পোশাক নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মতামত গঠনে ভূমিকা রাখছে। পোশাকের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিবেচনা খুব একটা কাজ করে না।

জরিপের ফলাফল থেকে এটাও লক্ষণীয় যে উচ্চবিত্ত নাগরিক ও নারীদের মধ্যে পাশ্চাত্যবিরোধী মূল্যবোধ অপেক্ষাকৃত বেশি।

তবে সামাজিক মূল্যবোধসংক্রান্ত ধাঁধাগুলোর বিশ্লেষণ আরও বিস্তৃত পরিসরে আলোচনার দাবি রাখে।

  • মির্জা হাসান, সৈয়দা সেলিনা আজিজ ও সুমাইয়া তাসনিম
    ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)-এ গবেষণা এবং শিক্ষকতায় যুক্ত।