বিশ্লেষণ
স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি হিমাগারে পাঠানোর দায় কার
২০১৬ সালের ২৪ মার্চ সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার অংশ হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি’ (এসএসকে) চালু করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে এ কর্মসূচির সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। দীর্ঘ আট বছর পর ‘পাইলট প্রজেক্ট’ চালিয়ে এভাবে এ কর্মসূচি স্থগিত করা কতটা যৌক্তিক এবং এর জন্য দায় কার, তা নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ আব্দুল হামিদ
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের উদ্যোগে ২০১২ সালে প্রণীত ২০ বছর মেয়াদি স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়ন কৌশলপত্র অনুযায়ী দারিদ্র্যসীমার নিচের জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য খরচের ঝুঁকি মোকাবিলা করে অতিদরিদ্রে পতিত হওয়া রোধ করতে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী, ঘাটাইল ও মধুপুর উপজেলায় সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার অংশ হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) চালু করা হয়।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের লক্ষ্যে ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এ কর্মসূচির অধীন নিবন্ধন করা প্রতিটি পরিবার বছরে ৫০ হাজার টাকার ইনপেশেন্ট চিকিৎসা (হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যে সেবা নিতে হয়) সুবিধা পায়। এ কর্মসূচির অর্থায়নের জন্য ‘স্বাস্থ্য অর্থায়ন অপারেশনাল প্ল্যান’-এর আওতায় পরিবারপ্রতি বছরে ১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার, যা স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এসএসকে সেলের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা করা হয়।
এ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য বিনা খরচে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ বঙ্গবন্ধুর মানবকেন্দ্রিক চিন্তার প্রতিফলনেরই অংশবিশেষ।
এ কর্মসূচি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠন এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সব নাগরিকের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা চালুর ঘোষণার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এ কর্মসূচি উপকারভোগীদের বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের ঝুঁকি কমাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের চতুর্থ সেক্টর প্রোগ্রামের ব্যাপ্তিকাল শেষ হওয়ায় এবং সময়মতো পঞ্চম সেক্টর প্রোগ্রামের কার্যক্রম শুরু করতে না পারার জন্য ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে এই কর্মসূচির সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, পঞ্চম সেক্টর প্রোগ্রামে এ কর্মসূচির অর্থায়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু তা শুরু হতে ৬ থেকে ১২ মাস লাগতে পারে। তাই আপাতত এ কর্মসূচি হিমাগারে স্থান পেয়েছে। মনে রাখা দরকার, বন্ধের সময়ে এ কর্মসূচির উপকারভোগীরা হাসপাতালে এসে এক দিকে যেমন কাঙ্ক্ষিত সেবা পাবে না, অন্যদিকে তারা আস্থা হারাবে। আস্থা ফিরিয়ে আনা বেশ সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ।
এটা রাস্তা, ব্রিজ বা কোনো কনস্ট্রাকশন (নির্মাণ) প্রকল্প নয় যে বন্ধ করে ছয় মাস কিংবা এক বছর পর চালু করলে তেমন সমস্যা হবে না। আসলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সামাজিক কর্মসূচি বিকল্প অর্থায়নের মাধ্যমে হলেও চালু রাখতে হয়। কিন্তু কেন এমন হলো এবং কারা এ অবস্থার জন্য দায়ী?
শুরুতে একটু ভারতের প্রসঙ্গে আসা যাক। ভারত দরিদ্র মানুষের ইনপেশেন্ট স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য ২০০৮ সালে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা’ নামে স্বাস্থ্য খাতে একটি সোশ্যাল সেফটিনেট কর্মসূচি শুরু করে। এর অধীনে কোনো প্রিমিয়াম প্রদান ছাড়া প্রতিটি দরিদ্র পরিবারকে বছরে ৩০ হাজার ভারতীয় রুপি সমমূল্যের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
এ কর্মসূচির অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে ২০১৭ সালে ভারতে ‘প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা’ নামে একটি সামাজিক বিমা কর্মসূচি চালু হয়। এটা পুরো বিশ্বে সবচেয়ে বড় সামাজিক বিমা কর্মসূচি।
এ কর্মসূচির অধীনে এক দিকে বেনিফিটের (সুযোগ-সুবিধা) পরিমাণ ৩০ হাজার রুপি থেকে ৫ লাখ রুপিতে উন্নীত করা হয়। অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের পাশাপাশি দরিদ্রের কাছাকাছি থাকা পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেন তারা চিকিৎসার খরচ বহন করতে গিয়ে দারিদ্র্যে পতিত না হয়। এটি ছিল সরকারের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয়। এ কর্মসূচির বেনিফিট ৫ লাখ রুপিতে উন্নীত হওয়ায় কম্প্রিহেনসিভ (সার্বিক) স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের পাশাপাশি দরিদ্রের কাছাকাছি থাকা পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করায় এটি ‘সোশ্যাল সেফটিনেট’ কর্মসূচি থেকে ‘উন্নয়ন কর্মসূচি’তে উন্নীত হয়েছে। এ কর্মসূচিকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য তারা ২০১৮ সালে একটি শক্তিশালী ‘ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি’ গঠন করে। এটি সরকারের আরেকটি বিচক্ষণতার পরিচয়।
ভারতের ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবিমা যোজনা’র অনুকরণে সোশ্যাল সেফটিনেট কর্মসূচি হিসেবে বাংলাদেশ এসএসকে কর্মসূচি চালু করে। কিন্তু দীর্ঘ আট বছর এসএসকে–কে পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু রেখে অবশেষে বিরতিতে পাঠানো হলো। এটা কোনোভাবেই বিবেচনাসুলভ নয়।
কোনো সোশ্যাল সেফটিনেট কর্মসূচি এত বছর ধরে পাইলটিং হয়েছে, এমন নজির গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দীর্ঘ আট বছর এসএসকে পাইলট প্রকল্প থেকে আমরা কী শিখলাম, সেটাও পরিষ্কার নয়।
অন্যদিকে ভারতের মতো একটি ‘ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি’ গঠন না করে এটার সম্প্রসারণ করা আরেকটি চরম অদূরদর্শিতা ও ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্বহীনতার পরিচয়। উল্লেখ্য, ২০২২ সালে এ কর্মসূচি টাঙ্গাইলের অন্য ৯টি উপজেলায় সম্প্রসারণ করা হয়।
তা ছাড়া বরগুনা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, মানিকগঞ্জ, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও ঢাকা মহানগরীতে (উত্তর ও দক্ষিণ উভয় অংশে) এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করার জন্য দরিদ্র পরিবার চিহ্নিত করা, স্কিম অপারেটর নিয়োগ দেওয়া, কার্ড প্রস্তুত করা, রেজিস্ট্রেশন শুরু করাসহ প্রায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। এ প্রস্তুতি বাবদ প্রায় ৩০ কোটি টাকা খরচ হয়।
এসএসকে কর্মসূচি চালুর অন্যতম পূর্বশর্ত ছিল এটিকে ব্যবস্থাপনার জন্য একটি ‘ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি’ গঠন করা, যা অর্থায়ন কৌশলপত্রের একটি প্রধান সুপারিশ ছিল। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট কিংবা স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর এ কর্মসূচি ব্যবস্থাপনার জন্য কোনোভাবেই উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। তাহলে দীর্ঘ আট বছরে কেন ‘ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি’ গঠনে উদ্যোগী হলাম না।
আবার এসএসকে যদি কার্যকর কোনো পন্থা না হয়, তাহলে কেন তা দীর্ঘ আট বছর ধরে চালু এটা রাখলাম। এটা কেন দুই-তিন বছর পরেই বন্ধ করলাম না। কেনই–বা তা পাইলট এলাকার বাইরে সম্প্রসারিত করতে গিয়ে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করলাম?
আবার এসএসকের কার্যক্রম স্থগিত করার এক দিন আগে ২৯ জুন কেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ঢাকা, মানিকগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুরে এসএসকে বুথ উদ্বোধন করলেন? এটি কি ‘সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা ব্যর্থতা’ নয়? উদ্দেশ্যবিহীন এসব কর্মকাণ্ডের দায় কি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকার এড়াতে পারবে?
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসএসকে মডেলে কিছু নতুন দিক আছে, যেমন সরকারি হাসপাতালকে সরকারের অন্য একটি সংস্থা থেকে সেবামূল্য গ্রহণের সুযোগ দেওয়া; প্রাপ্ত অর্থ থেকে সরকারের মূল্যতালিকা অনুযায়ী ডায়াগনস্টিক সেবার মূল্য ও অ্যাম্বুলেন্স চার্জ সরকারি কোষাগারে জমাদান; উদ্বৃত্ত অর্থ জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং হাসপাতালের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয়ের সুযোগ সৃষ্টি; জরুরি অবস্থা ও রেফারেল ছাড়া উচ্চতর হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ না থাকা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ওষুধ এবং ডায়াগনস্টিক সেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত করা। স্বাস্থ্য খাতের বিদ্যমান সমস্যা দূরীকরণে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এই বৈশিষ্ট্যগুলো যোগ করা বেশ জরুরি।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় এসএসকে কর্মসূচির ‘বেনিফিট’ পরিবারপ্রতি বছরে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় উন্নীত করে এটিকে সর্বজনীন করতে পারলে জনগণকে ইনপেশেন্ট স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি চালু করা সম্ভব। পাশাপাশি দেশের যে ৫-৬ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্যের ব্যয় বহন করতে গিয়ে দারিদ্র্যে পতিত হয় এবং যে ২৫ শতাংশ পরিবার বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হয়, তা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব।
যাদের অজ্ঞতা, অবহেলা, স্বেচ্ছাচারিতা ও খামখেয়ালিপনায় স্বাস্থ্য খাতের এ অমিত সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা দায়িত্ব সরকারের। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সরকার এসএসকে কর্মসূচির বেনিফিট পরিবারপ্রতি বছরে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় উন্নীত করে এটিকে সর্বজনীন করার রাজনৈতিক সাহস ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে, সেটাই প্রত্যাশা করি।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।