প্রতিশোধের উন্মত্ততা: ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’

বৈষম্যবিরোধী শান্তিপূর্ণ ছাত্র বিক্ষোভ মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের অদূরদর্শী পদক্ষেপ, সরকারি ও নিজস্ব পেটোয়া বাহিনীর হামলায় ছাত্র–জনতার প্রাণহানিতে নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ দেখতে পেল বাংলাদেশ।

চলতি আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সেই বিস্ফোরণের প্রচণ্ডতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরে দেশের এযাবৎকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইস্তফা ও আকস্মিক দেশত্যাগের ঘটনা এবং তৎপরবর্তী দেশব্যাপী ক্ষুব্ধ জনতার পাল্টা প্রতিরোধ, হত্যা, নৈরাজ্য, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ হিংসাত্মক ঘটনাবলি অনেক বার্তা রেখে গেল সবার জন্য।

৫ আগস্ট (ছাত্রদের ভাষায় ৩৬ জুলাই) সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান বক্তব্যের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবর পাওয়ামাত্র ক্ষুব্ধ জনতা আনন্দ প্রকাশের পাশাপাশি চরম উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে।

একটা অংশ নেমে পড়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ হিংসাত্মক ঘটনাবলির মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টিতে। এটা সবারই জানা যে উচ্ছৃঙ্খল জনতার লক্ষ্যবস্তু ছিল বিভিন্ন পুলিশ স্টেশন, টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা–কর্মী, তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ বাড়িঘর। দীর্ঘদিন মামলা–হামলা, গুম–খুনসহ নানা দমন–পীড়নে অতিষ্ঠ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লোকজন প্রতিশোধের উন্মত্ততায় দেশব্যাপী চরম নৈরাজ্য তৈরি করে। হিংসার আগুনে এই দফায় ঝরে যায় অনেক প্রাণ, ক্ষয়ক্ষতি হয় বিপুল সম্পদের।

কেবল আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীরাই নন, ক্ষুব্ধ জনতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় সরকারি দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা পুলিশ প্রশাসনসহ নানা দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও। তাঁদের একটা অংশ সম্ভাব্য পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরে আগেভাগে বিদেশে পালিয়েছেন, কেউ সরাসরি আক্রান্ত হয়েছেন, কেউ সৌভাগ্যক্রমে পালিয়ে বেঁচেছেন, আবার কেউ কেউ ঘটনা–পরবর্তী দেশত্যাগ করতে গিয়ে বিফল হয়ে কিংবা ধরা পড়ে সরকারি হেফাজতে আছেন।

আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজন এবং নানাভাবে তাদের অংশীজনদের ওপর দেশের জনগণের বড় একটা অংশের প্রতিশোধের উন্মত্ততা দৃশ্যমান হলো কেন?

রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের দাপটে নিজেরা এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রশাসনকে ব্যবহার করে আওয়ামী ঘরানার লোকজন বিরোধী পক্ষকে সম্ভব সব উপায়ে অত্যাচার–নিপীড়ন করেছে। এরা জবরদখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অন্তঃকলহ, ক্যাসিনোবাজি, জুলুম-নির্যাতন, অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়, ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অপরাধলব্ধ বিপুল অর্থে সহায়–সম্পদ গড়েছে, কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছে, শপিং মল-মার্কেট-অভিজাত এলাকায় জমি বা প্লট-ডুপ্লেক্স বাড়ি বা ফ্ল্যাট বাগিয়েছে, অপরের কিংবা বনের জমি জবরদখল করে রিসোর্ট–বাগানবাড়ির মালিক হয়েছে, অঢেল অর্থের একটা অংশ পাচারের মাধ্যমে বিদেশে সেকেন্ড হোম গড়েছে। মোটকথা, চৌদ্দ পুরুষের সারা জীবন বসে খাওয়ার মতো সম্পদ তারা গড়ে নিয়েছে।

অথচ এসব বিত্তবৈভবের পরতে পরতে মিশে আছে নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস। নিজেদের আখের গোছাতে গিয়ে এরা সীমাহীন দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে, শত শত অসহায় মানুষকে নিঃস্ব করেছে, পথে বসিয়েছে, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে অকালে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তাদের উত্তরাধিকারের সামনে উপহার দিয়েছে মহা অনিশ্চয়তা। মজলুম ওই সব পরিবারের যেসব সদস্য বেঁচে আছে, টিকে আছে এখনো এবং নানা কারণে ক্ষুব্ধ লোকজন এমন মোক্ষম সময়ে প্রতিশোধ নিতে চাইবেই। তাদের ক্ষোভের আগুনের সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিস্থিতিতে ভেসে আসা সুযোগসন্ধানী শ্রেণি। দেড় দশকের জমে থাকা রাগ–ক্ষোভের আগুনে পুড়েছে, ধ্বংস হয়েছে জুলুমকারীদের ঘরবাড়ি ও সম্পদ।

প্রজাতন্ত্রের কর্তারা মনে রাখা উচিত, নেহাতই নিজেদের আর্থিক সুবিধার নিমিত্তে হাস্যকর অজুহাতে দল বেঁধে বিদেশ ভ্রমণে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় করানোর মানসিকতাও আপনাদের পরিহার করতে হবে। মেধা ও যোগ্যতায় শ্রেয়তর অবস্থানের সুবাদে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আপনারা দেশসেবার জন্য মনোনীত হয়েছেন। এই পবিত্র দায়িত্বের কথাটা ভুলে যাওয়া কাম্য হতে পারে না।

আমাদের শিক্ষা এটা শিখিয়েছে,অস্বাভাবিক কোনো কিছুই ভালো না। মন্ত্রী–সংসদ সদস্য, বড় ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পপতি হলে ভিন্ন কথা। কিন্তু সাধারণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের এটা আমলে রাখলে ভালো হয়, আপনাদের ঘরবাড়ি–ভবনে কিংবা জীবনাচরণে যখনই বাড়তি চাকচিক্য যোগ হবে, এখন থেকে আশপাশের মানুষ এটা ধরে নেবে যে এর নেপথ্যে রয়েছে অবৈধ অপরাধলব্ধ আয়।

দেড় দশক যাবৎ দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা–কর্মীও স্বল্পতম সময়ে ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে বিপুল অর্থসম্পদে সমৃদ্ধ হচ্ছে, পাশাপাশি প্রভাব বলয় তৈরির মাধ্যমে আশপাশের মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের পথে বাধা হয়ে উঠছে। জাতীয় বা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনে প্রাক্কালে ব্যক্তিগত বা দলীয় সম্ভাবনা নিশ্চিতে পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে নানা ছুতায় গায়েবি মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে ভিন্নমতাবলম্বীদের। এসব মামলার কবলে পড়ে অনেক নিরীহ পরিবার পথে বসে। জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের দাপটের কথা আর নাই–বা বললাম।

এটা মনে রাখার জন্য বিনীত অনুরোধ রাখা যাচ্ছে, জনগণের নেতা না হয়ে গোষ্ঠীবিশেষের নেতা হয়ে অন্যদের ওপর জুলুম করলে ওই বঞ্চিত–নিপীড়িত মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাস–হাহাকার স্রষ্টার কাছে পৌঁছে যায়। জনগণ একদিন না একদিন ফুঁসে উঠবেই। তখন কিন্তু জনরোষের শিকার হবেন, বিক্ষুব্ধ জনতা সব চুরমার করে দেবে, জনগণের শক্তির সামনে কোনো বাধাই টেকে না। সম্প্রতি চাঁদপুরের ‘বালুখেকো’ সেলিম চেয়ারম্যান ও তাঁর চলচ্চিত্র অভিনেতা পুত্রের পালাতে গিয়ে গণপিটুনিতে নির্মম মৃত্যু আমাদের সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁদের এমন পরিণতি কোনোভাবেই কাম্য ছিল না।

আর নিষ্পাপ শিশু, নিরস্ত্র ছাত্র–জনতার ওপর গুলি চালিয়ে নির্বিচার গণহত্যার পরিণতি নির্দেশদাতার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক ও নির্মম হতে পারে টের পেয়েছেন দেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। দীর্ঘদিন পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো নিপীড়িত সেই জনগণেরই ভয়ে আতঙ্কে এখন পুলিশ সদস্যরা দিশাহারা।

এসব মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। এমন নৈরাজ্য দেখতে চায় না কেউই। আইনের চোখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার এসব ফৌজদারি অপরাধের শাস্তি হয়তো হবে একদিন। আর দেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে নির্বিচার লুটপাটকারীদেরও টিভি ক্যামেরার ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

ছাত্র–জনতার গণ-অভ্যুত্থানে দেশকে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে নিতে ভবিষ্যতে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশে প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো চৌকস ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সরকারি সংস্থা গঠন করা যেতে পারে। রাজনীতিক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, আমলা—যে কারও জীবনযাপনে তাঁর আয়ের সঙ্গে সংগতিহীন ব্যয়ে অতিমাত্রায় বাহুল্য, স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত বিলাসী চালচলন পরিলক্ষিত হলেই যে কেউ বিষয়টি সরকারি সেই বিশেষ সংস্থার গোচরে আনতে পারেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক হলেও তা জানানোর সুযোগ রাখা হবে তথ্যদাতার নাম–পরিচয় গোপন রাখার নিশ্চয়তায়। এ ক্ষেত্রে অসত্য তথ্যদাতার জন্যও থাকবে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা। বিদেশি মেধাবৃত্তি ছাড়া সাধারণ চাকরিজীবী, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীর সন্তানরা নিজ খরচে বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভে যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিশাল অর্থ ব্যয়ের সামর্থ্য যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিদেশে সেকেন্ড হোম বেগমপাড়ায় অর্থ পাচারের বিরুদ্ধেও থাকবে কঠোর শাস্তির বিধান।

নতুন এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে পরিবর্তনের যে সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে, তারই প্রত্যাশিত সূচনার প্রাক্কালে আহ্বান থাকবে, সবাই স্বীয় অবস্থান থেকে নিজেদের শুধরে নিই, অল্প সময়ে বিপুল বিত্তবৈভবের অধিকারী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করি।

ভালো দায়িত্বশীল নাগরিক হই, জনগণের মনের ভাষা বোঝার চেষ্টা করি, তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার মানসিকতা নিজেদের ভেতর তৈরি করি। অমর হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করি। তাতে আকস্মিক পটপরিবর্তনের গণজোয়ারের মুখে সব ছেড়ে চোরের মতো পালাতে হবে না। প্রকৃত জননেতা হলে যেকোনো বিপদে জনগণই আপনাকে আগলে রাখবে, স্মরণে রাখবে শ্রদ্ধায়–ভালোবাসায়।

প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী দুনিয়াটা চলে একটা ভারসাম্যের নিয়ম মেনে। এটা বোঝার মতো জ্ঞান হয়তো সবারই আছে। কিন্তু অনেকেই টাকার নেশায় এতটাই বুঁদ থাকে যে তারা ভুলে যায় তা। আমাদের জাতীয় কবি, দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই গানের চরণ—‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, আজকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়’ স্মরণে রাখি সবাই।

  • মুহাম্মদ লুৎফুল হায়দার ব্যাংকার।