ছাত্র–জনতার আন্দোলনের ফলে শেখ হাসিনার পদ ও দেশত্যাগ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন সূচনা—এগুলো এখন সবই জানা কথা। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকতে সম্পূর্ণ একজন একনায়কে পরিবর্তিত হয়েছিলেন। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে ‘একনায়ক’ শব্দটি আমরা এত দিন ভয়ে ব্যবহার করিনি। তাঁর একনায়কতন্ত্রের পেছনে আমাদের অর্থাৎ রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, ছাত্র–শ্রমিক ও সাংবাদিক সবারই কমবেশি দায় এবং দায়িত্বহীনতা ছিল।
রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের ভেতরে গণতন্ত্রের ঘাটতি ছিল; বুদ্ধিজীবীরা হালুয়া–রুটির আশায় নিজের বুদ্ধিমত্তা ও স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই বিক্রি করে দিয়েছিলেন; সুশীল সমাজও ভয়ভীতিতে ছিল আতঙ্কিত; ছাত্র–শ্রমিকদের সংগঠিত করতে শক্তিশালী সংগঠন ছিল না। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য সংবাদমাধ্যমগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবান্বিত করেছে। ফলে শেখ হাসিনা একনায়কে পরিণত হয়েছেন।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের গতকাল প্রথম আলোতে ‘গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি’ শিরোনামে লেখায় আমাদের সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালিদের বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের ইতিহাস। সেই ইতিহাসটা আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ভোলেনি। তাদের একটা দাবির আন্দোলনকে কীভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আন্দোলনে রূপ নিতে পারে, তা দেখিয়ে দিতে তাদের দুই মাস সময়ও লাগেনি। একই সঙ্গে জনগণও তাদের বিদ্রোহী চেতনায় রাতারাতি উদ্ভাসিত হয়ে গেল। ফলে এই অভাবনীয় ও অকল্পনীয় পরিবর্তন।
গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনা থেকে আমাদের ভবিষ্যতে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও অন্য ব্যক্তিদের সব সময়ই মনে রাখতে হবে, ছাত্র–জনতাকে আর কোনো দিন তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও উপেক্ষা করা যাবে না। ক্ষমতার মালিক জনগণ। তাঁরা কিছু সময়ের জন্য কিছু ব্যক্তিকে তাঁদের ক্ষমতার কিছু অংশ সাময়িকভাবে হস্তান্তর করেন। এই সাময়িক হস্তান্তরের প্রক্রিয়া হলো নির্বাচন। কিন্তু ক্ষমতার মালিক থাকেন জনগণই।
নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বে যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা আসীন হন না কেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, এটি জনগণের স্বার্থে তাঁদের একটি সাময়িক দায়িত্ব এবং এই দায়িত্বটা সম্পূর্ণ জবাবদিহির মধ্যে তাঁদের পালন করতে হবে। ছাত্র–জনতা এটাই আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে। আর আমরা যাতে এই দায়িত্বের সীমাবদ্ধতা ও ক্ষণস্থায়িত্ব কখনো ভুলে না যাই।
আমরা যাঁরা আমাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে দেশটাকে একনায়কের হাতে তুলে দিয়েছিলাম, আমাদেরও এই ছাত্র–জনতার কাছ থেকে নতুনভাবে শিক্ষা নিয়ে আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। দেশটা এখন সত্যিকারের উন্নতির পথে এগোবে।
ড. শাহদীন মালিক, অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক।