রাশিয়া-চীন উভয়কে চাপে রাখা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বোকামি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতিযোগিতা উত্তপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস এবং রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতণ্ডা তীব্রতর হচ্ছে। অভিবাসন, প্রজনন অধিকার, সামাজিক খাতের সরকারি ব্যয় ইত্যাদি ইস্যুতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে তাঁরা একে অন্যকে আক্রমণ করে যাচ্ছেন। তবে এসব ইস্যুকে ছাপিয়ে যে ইস্যুতে দুজনই খুব জোর দিচ্ছেন, তা হলো চীন।

বিশ্বমঞ্চে ওয়াশিংটনের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করা পরাশক্তি চীনের বিষয়ে কোন কৌশল নীতি অনুসরণ করা যায়, সে সম্পর্কে যদিও কমলা ও ট্রাম্পের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তবে চীন যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় হুমকি, সে বিষয়ে তাঁরা নীতিগতভাবে একমত। তাঁরা কীভাবে চীনকে মোকাবিলা করবেন, সেটিই এখন বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কমলা হ্যারিস তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অনুসৃত নীতির পথেই হাঁটবেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা অংশীদারিকে অর্থনৈতিক জোটে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করবেন। একই সঙ্গে যে দেশগুলো চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করবে, তাদের সাজা দেওয়ার পথেই তিনি হাঁটবেন।

কমলা হ্যারিস সম্ভবত চীনের দিক থেকে আসতে পারে, এমন যেকোনো ধরনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকার জন্য বেইজিংয়ের ওপর চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। জো বাইডেনের অনুসৃত নীতির পথে হেঁটে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনশিল্পকে সরিয়ে নেওয়াকে উৎসাহিত করবেন। এই নীতি তৃতীয় দেশগুলোকে উপকৃত করতে পারে। ভিয়েতনামের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন অংশীদারদের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই তা ঘটেছে। কয়েকটি পশ্চিমা কোম্পানি চীন থেকে তাদের কার্যক্রম ভিয়েতনামে সরিয়ে নেওয়ার কারণে ইতিমধ্যেই ভিয়েতনামের এফডিআই (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) প্রবৃদ্ধি বেড়ে গেছে।

ডেমোক্র্যাটরা ‘চিপস অ্যান্ড ইনফ্ল্যাশন রিডাকশন অ্যাক্ট’ শীর্ষক আইনটির যথাযথ প্রয়োগ চাইছে। ওই আইনে মাইক্রোচিপ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি বেইজিংয়ের ‘চুরি করে নিয়ে যাওয়া’ শিল্পকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনতে চায়। অন্যদিকে ট্রাম্প তাঁর পূর্ববর্তী প্রচারাভিযানের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকার স্বার্থ আগে’ স্লোগানটিকে এবার দ্বিগুণ গতিতে প্রচার করছেন। তিনি উনিশ শতকের অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করে আমদানির ওপর বড় ধরনের শুল্ক আরোপের পক্ষে কথা বলছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকেরা বিশেষ করে চীন থেকে পণ্য আমদানি করতে চাইলে তাদের বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি শুল্ক দিতে হবে, এমন আইন পাস করতে চান। এর মধ্য দিয়ে তিনি চীনা পণ্যকে কোণঠাসা করার নীতি অনুসরণ করবেন। এই নীতিগুলোর মাধ্যমেই ট্রাম্প মার্কিন ভূ-অর্থনৈতিক নীতিকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছেন।

সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, আজ ডেমোক্রেটিক বা রিপাবলিকান—কোনো দলই চীনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার কথা বলছে না। ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস—উভয়ের প্রচারণায় চীনকে দূরে ঠেলে মার্কিন অর্থনৈতিক স্বার্থকে রক্ষার কথা বলা হচ্ছে। তাঁদের লক্ষ্য অভিন্ন কিন্তু কৌশল ভিন্ন। কিন্তু তাঁরা দুজনেই এই সত্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে মার্কিন আধিপত্যশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সামনে চীনের চেয়ে অনেক বেশি হুমকি হচ্ছে রাশিয়া এবং একই সঙ্গে বেইজিং ও মস্কো উভয়কে চাপে রাখতে যাওয়াটা বোকামি হবে।

যুক্তরাষ্ট্রকে স্বীকার করতেই হবে, বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশের কাছেও চীন অর্থনৈতিক জায়গা থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক কারণে এসব মিত্রদেশের পক্ষে চীনের সঙ্গ ত্যাগ করা সম্ভব নয়। এই সত্য রাশিয়ার ক্ষেত্রেও সত্য।

ইউরেশীয় বাণিজ্যের ‘মধ্য করিডর’ অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র জোর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই অঞ্চলে চীনের কেনাকাটা বন্ধ করতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্রের সেই চেষ্টা খুব সামান্যই কাজে আসবে। আবার সেখানে চীনের কেনাকাটা বন্ধ করার ক্ষেত্রে বা অন্যান্য দিক থেকে চীনের ওপর খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করা হলে সেটি আবার রাশিয়ার ভূ-অর্থনৈতিক এজেন্ডাকে বাধাগ্রস্ত করার ক্ষেত্রে পাওয়া মার্কিন অগ্রগতিকে ভন্ডুল করে দিতে পারে।

সে জন্য একই সঙ্গে চীন ও রাশিয়াকে দমন করতে যাওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিরত থাকতে হবে। এই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এখন চীনের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানো উচিত। সেটি সম্ভব না হলে অন্ততপক্ষে রাশিয়ার প্রতি চীনের সমর্থন যতটা সম্ভব সীমিত করা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

  • ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো

    আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত