মতামত
স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য যে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে
ডিজিটাল রূপান্তরকে মাথায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা যেমন করা যায়, তেমনি আবার স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য কিছু পরিকল্পনাও আগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া যেতে পারে। সেই ধরনের কিছু পরিকল্পনা নিয়ে লিখেছেন বি এম মইনুল হোসেন
সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। সঙ্গে সঙ্গে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাদীক্ষা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন নানা কর্মকাণ্ডের ডিজিটাল রূপান্তর। দেশে এ মুহূর্তে রয়েছে প্রায় ৭ কোটি ৭৩ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, ১৮ কোটি ৮৬ লাখ মোবাইল সংযোগ এবং ৫ কোটি ২৯ লাখ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী। দেশের ৩৭ দশমিক ৭ ভাগ মানুষের কোনো না কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট আছে। অপর দিকে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে মাত্র শূন্য দশমিক ৬ ভাগ মানুষ (ডেটা রিপোর্টাল, ২০২৪)।
এ পরিসংখ্যানে কিছুটা এদিক-সেদিক হলেও এটি নিশ্চিত যে আন্তর্জাতিক বা আন্তসীমানা লেনদেনের ক্ষেত্রে নাগরিকদের নির্ভর করতে হয় সময়সাপেক্ষ ব্যাংকিং চ্যানেল বা ব্যয়বহুল অন্য কোনো মাধ্যমের ওপর। ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনের ক্ষেত্রেও আছে নানা শর্ত ও সীমাবদ্ধতা। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে একটি ই–মেইল আদান-প্রদানের জন্য যে সময় প্রয়োজন, অর্থ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রেও গ্রাহকেরা তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে নারাজ। ফ্রিল্যান্সিং থেকে শুরু করে ক্রসবর্ডার ই-কমার্স, সব ক্ষেত্রেই এটি একটি বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যান্য দেশে এর সহজ সমাধান পেপ্যাল বা সমজাতীয় পরিষেবাগুলো। বিশ্বের দুই শর বেশি দেশে পেপ্যালের কার্যক্রম চালু থাকলেও বাংলাদেশে এখনো কার্যক্রম শুরু করেনি এই প্রতিষ্ঠানটি। তথ্যপ্রযুক্তি খাত–সংশ্লিষ্ট মানুষ বহু বছর ধরে এই পেপ্যালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি, পেপ্যাল বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করতে না পারার কারণও অস্পষ্ট। এ মুহূর্তে সরকারের পক্ষ থেকে ছোট একটি দল করে পেপ্যালের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। ব্যবসা পরিচালনায় পেপ্যালের সমস্যাগুলো কী, সেটি নিরসনের উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে কূটনৈতিক মাধ্যমও ব্যবহার করা যেতে পারে।
কোনো দেশে ১০ শতাংশ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বাড়লে জিডিপি বেড়ে যায় ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ (বিশ্বব্যংক) এবং গ্রামীণ এলাকায় ১০ শতাংশ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বাড়লে কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়ে যায় ২ থেকে ৩ শতাংশ (আইটিইউ)। এদিকে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ অনলাইন শিক্ষার প্ল্যাটফর্ম কোর্সে রাতে সম্পৃক্ত হয়েছে ১৪ কোটির বেশি শিক্ষার্থী। ওদিকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিশ্বে ই-কমার্স বাজার হবে ৬ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের।
এই সব কার্যক্রমের মূল চালিকা শক্তি হলো উচ্চগতির ইন্টারনেট। দেশের বহু জায়গায় ইন্টারনেট পৌঁছে গেলেও সেটির দাম এবং সেবার মান নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। ইন্টারনেটের মোবাইল প্যাকেজ নিয়েও আছে বিভিন্ন ধরনের আপত্তি। যেখানে মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন দেশের ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যবহারকারী (ডেটা রিপোর্টাল)। গতি ও দামের বিবেচনায় আমরা উন্নত দেশ তো দূরে থাক, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ থেকেও পিছিয়ে।
কীভাবে আমরা উচ্চগতির ইন্টারনেট দুর্গম জায়গায় নিয়ে যেতে পারি, সেটিকে কীভাবে আরও সহজলভ্য করে সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার ভেতরে নিয়ে আসতে পারি, সেটি নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।
তৈরি পোশাক খাতের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, সেখানে কয়েক লাখ মানুষ কাজ করছেন। তাঁরা উচ্চ ডিগ্রিধারী নন, কিন্তু হাতে-কলমে কাজটা শিখে দক্ষতা অর্জন করেছেন। আমাদের মতো জনবহুল দেশের জনসংখ্যাকে সেখানে কাজে লাগানো গেছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোথাও যদি আমরা এই বিপুল জনসংখ্যাকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিতে পারি, তাহলে এই খাতেও তৈরি পোশাক খাতের মতো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। উচ্চদক্ষতা সম্পন্ন ২ জন যেমন অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে, মধ্যম বা মোটামুটি দক্ষতার ২ জন না হোক, ২০ জনের তো অন্তত সেই অবদান রাখতে পারা উচিত। তথ্যপ্রযুক্ততিতে অনেকসংখ্যক মানুষকে সম্পৃক্ত করার সেই খাত হতে পারে বিপিও (বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং) বা সেবা (সার্ভিস) খাত। এর মধ্যে গ্রাহকসেবা, প্রযুক্তিগত সহায়তা, টেলিমার্কেটিং, ছবি সম্পাদনা, হিসাবরক্ষণ, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদিসহ নানা কার্যক্রম রয়েছে, যেগুলো স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুরু করা যায়।
আমাদের কারিগরি ও ভিত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি আমরা এই ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কার্যকরভাবে প্রস্তুত করতে পারি, তাহলে সারা দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে হয়তো এ ধরনের কার্যক্রমের পরিকল্পনা ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো কতটুকু কার্যকর, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। সব মনোযোগ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না দিয়ে সরকারের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মনোযোগ দিতে হবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে। স্বল্প সময়েই এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।