অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার চালু হওয়া (১৯৬৯) ইস্তক গত ৫২ বছরে ব্যাংকিং বিষয়ে অবদানের জন্য কোনো পুরস্কার দেওয়া হয়নি। নিখাদ ব্যাংকিং বিষয়ে গবেষণা ও অবদানের জন্য ২০২২ সালের পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে বেন এস বার্নানকে, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ফিলিপ এইচ ডিবভিগ—এই তিন আমেরিকান অর্থনীতিবিদকে।
তাঁদের মধ্যে প্রথমজন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান ছিলেন দীর্ঘ আট বছর। তাঁর সময়েই যুক্তরাষ্ট্রে সাবপ্রাইম সংকট পুরো পশ্চিমি দুনিয়ার অর্থবাজার ও অর্থনীতিকে স্থবির করে দিয়েছিল। সামান্য হলেও যার অভিঘাত এসে লেগেছিল আমাদের দেশেও।
বার্নানকের গবেষণার একটা প্রধান ক্ষেত্র ছিল ১৯৩০ দশকের মহামন্দা। তিনি দেখিয়েছেন, অর্থনৈতিক দুরবস্থার সেই কালবেলায় লালবাতি জ্বালানো ব্যাংকগুলো চরমতম আর্থিক সংকটকে আরও তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী করেছিল। তাঁর মতে, ভূতত্ত্ব সম্পর্কে জানার জন্য যেমন ভূমিকম্পের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে হয়, তেমনি অর্থনীতি বুঝতে হলে মন্দা নিয়ে গবেষণা করতে হবে।
বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় ১৯৭০ -এর দশকের সমিল পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের ব্যয় সংকোচন এবং শিল্প খাতের মন্থরতার কারণে একটা স্ট্যাগফ্লেশনের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। বার্নানকের তত্ত্বের বিপরীতে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য দেশে দেশে ঊর্ধ্বগামী সুদের হার কি তাহলে ভুল সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যার একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ?
বার্নানকে তাঁর স্মৃতিকথা দ্য কারেজ টু অ্যাক্ট গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, ২০০৮ সালে সাবপ্রাইম সংকটের সময় কংগ্রেসের বাধা উপেক্ষা করে কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইনস্যুরেন্স কোম্পানি এআইজিকে উদ্ধার করার একটা প্রায়-অসম্ভব ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট বুশের কাছে তিনি ব্যাখ্যা করেন, কোম্পানিটিকে বাঁচানোর জন্য কেন ফেডারেল রিজার্ভ ৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। কোম্পানিটি কিংবা তার কর্মচারী বা শেয়ারহোল্ডারদের সাহায্য করার অভিপ্রায়ে এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না তিনি। বার্নানকে প্রেসিডেন্টকে বোঝাতে পারেন যে আবাসন ঋণের উন্মত্ততায় অবিমৃশ্যকারিতা দেখিয়ে এআইজি বিপদে পড়েছে বটে, কিন্তু এই কোম্পানি দেউলিয়া হলে আমেরিকার অর্থব্যবস্থা ও অর্থনীতি কোনোভাবেই সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে না।
বার্নানকে যেদিন প্রেসিডেন্টের কাছে তাঁর অভিপ্রায় ও সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন, তার ছয় মাস আগে জে পি মরগ্যান ব্যাংককে তিন হাজার কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ, যাতে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বিয়ার স্টার্নসকে বাঁচানো যায়। সাবপ্রাইম সংকটের মূল অনুঘটক আবাসন ঋণের প্রায় অর্ধেকের জোগানদাতা কোম্পানি ফ্যানি মে এবং ফ্রেডি ম্যাককে অধিগ্রহণ করেছে সরকার। মাত্র আগের দিন লেম্যান ব্রাদার্সের মতো ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষণা করেছে নিজেদের। তখনো এনরনের পতন হয়নি, তবে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল সবার অগোচরে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে এআইজিকে উদ্ধার করার সিদ্ধান্তের ভেতর ছিল মারাত্মক রাজনৈতিক ঝুঁকি। মাত্র কদিন আগে বুশের রিপাবলিকান পার্টি ঘোষণা দিয়েছে, কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উদ্ধার করার সিদ্ধান্তে দলের সমর্থন মিলবে না। নিজেদের ভুলে বিপর্যস্ত এআইজিকে উদ্ধার করার এ সিদ্ধান্ত নীতিবহির্ভূত হলেও বার্নানকে বুঝতে পারেন, দেশের অর্থনীতি যে টালমাটাল সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এআইজির মতো প্রতিষ্ঠানের পতন ঘটলে তার চেয়ে আরও বেশি অকল্পনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। প্রেসিডেন্ট বুশ বার্নানকের ওপর অগাধ আস্থায় অভাবনীয় এ সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্টের নিরুপায় সম্মতি মিললেও কংগ্রেস সদস্যরা অনেক জেরার পর এ সিদ্ধান্তকে কোনো মৌখিক সমর্থনও দেননি, উল্টো সাফ জানিয়ে দেন, এটা ফেড চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত এবং সব দায়দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে, কংগ্রেস কোনো দায়িত্ব নেবে না।
বার্নানকে স্বীকার করেন যে সাড়ে আট হাজার কোটি ডলার অনেক অর্থ এবং তাঁর পরিকল্পনাটা বিপজ্জনক হলেও তার চেয়ে আরও বেশি বিপদে রয়েছে দেশটির অর্থনীতি। এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত ফেডারেল রিজার্ভের ভবিষ্যৎও। প্রেসিডেন্ট এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিচ্ছেন বটে, কিন্তু কয়েক মাস পর শেষ হতে যাচ্ছে তাঁর মেয়াদকাল। তিনি লেখেন, ‘যদি আমরা ব্যর্থ হই, ফেডের নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলবে ক্ষুব্ধ কংগ্রেস।’ সিদ্ধান্তটা এতই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল যে বার্নানকে শেষ মুহূর্তে একবার পিছিয়ে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘রাজনৈতিকভাবে একটা স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেই দেশের দীর্ঘমেয়াদি মঙ্গলের জন্য রাজনৈতিকভাবে অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে ফেড।’
সাবপ্রাইম সংকটে প্রায় বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য বার্নানকের বিভিন্ন দুঃসাহসী পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থব্যবস্থার ওপর আস্থা অটুট রাখা। তিনি জানেন, মন্দাবস্থায় খেলাপি হওয়ার আশঙ্কায় ব্যাংকগুলো সাধারণত ঋণ বিতরণে অনাগ্রহী হয়, যা অবস্থার আরও অবনতি ঘটায়। তাই বার্নানকের মূল তত্ত্ব ছিল সুদের হার কমিয়ে ব্যাংকগুলোর কাছে অর্থপ্রবাহ সুলভ করা। তবে সমালোচকেরা দাবি করেন, তাঁর এই তত্ত্ব ও উদ্যোগ মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছিল।
বার্নানকের সঙ্গে নোবেল পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেওয়া ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ফিলিপ এইচ ডিবভিগ গবেষণায় দেখিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি আমানত ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মধ্যকার গরমিলের কারণে আমানতকারীরা যদি বেশি পরিমাণে সঞ্চয় তুলে নেয়, তখন ব্যাংক লালবাতি জ্বালতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় কোনো ভালো ব্যাংকও যদি পতনোন্মুখ হয়, সেটি দ্রুততম সময়ে ঋণ ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করে, যা অর্থব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত এবং দেশের উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে স্থবির করে দেয়। সে জন্য ডায়মন্ড ও ডিবভিগ পরামর্শ দেন, যাতে ব্যাংকগুলোর আমানতকাঠামোয় যথেষ্ট তারল্য থাকে, সেটি আমানতকারীদের আস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
লক্ষণীয়, বার্নানকে, ডায়মন্ড, ডিবভিগ—তিনজনেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব ও স্থিতিশীলতা। এ লক্ষ্যে বার্নানকে কেবল তাত্ত্বিক বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান হিসেবে তাঁর তত্ত্ব ও মতবাদকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণত, সুদের হার নিয়ে আমেরিকার সরকার ও ফেডারেল রিজার্ভের পরস্পরবিরোধী অবস্থান প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে, কারণ, সরকার জনমত বিচারে সব সময়ই সুদের হার বাড়ানোর বিপক্ষে।
বার্নানকে ছিলেন এ ব্যাপারে ব্যতিক্রমী, কারণ তিনি মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা উপেক্ষা করে সাবপ্রাইম সংকটের সময় সুদের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছিলেন, যাতে মানুষের কাছে অর্থ সহজলভ্য হয়। ১৯৩০ সালের মহামন্দার মূল কারণ যে অপ্রতুল অর্থ সরবরাহ, এটি নিশ্চিত হওয়ার পর বার্নানকের চিন্তাজগতে এক নতুন ধারণার জন্ম হয়, যার বাস্তব প্রয়োগ তিনি করেছিলেন ২০০৮ সালের মন্দা মোকাবিলা করার জন্য।
বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় ১৯৭০-এর দশকের সমিল পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের ব্যয় সংকোচন এবং শিল্প খাতের মন্থরতার কারণে একটা স্ট্যাগফ্লেশনের আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। বার্নানকের তত্ত্বের বিপরীতে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য দেশে দেশে ঊর্ধ্বগামী সুদের হার কি তাহলে ভুল সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যার একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ?
ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার