প্রবৃদ্ধির হার কি নিছকই একটি সংখ্যা

অতিসম্প্রতি বিশ্বব্যাংক তাদের ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্ভাবনা’ প্রতিবেদনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার প্রক্ষেপণ করেছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ বলে। গত অর্থবছরে এই হার ছিল ৫ শতাংশ। বলা বাহুল্য, এ বছরের জন্য বিশ্বব্যাংক তার পূর্ববর্তী প্রাক্কলিত হারকে কমিয়ে নিয়ে এসেছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৪ দশমিক ১ শতাংশে।

মনে হচ্ছে, কোভিড-১৯ অতিমারির পরে বাংলাদেশের এই হার হচ্ছে সর্বনিম্ন। কয়েক মাস আগে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হারকে কমিয়ে নিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশ সরকারও তেমনটাই করেছে। তবে বিশ্বব্যাংকের সম্ভাবনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, পাকিস্তানের ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

বর্তমান অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভাবনার কারণগুলো সবার জানা আছে। বিগত দিনগুলোর যে অব্যবস্থাপনাময় অর্থনীতি আমরা পেয়েছি, দীর্ঘদিনের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি খাতসহ দুর্বল শিল্প উৎপাদন, বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগের হ্রাস, জ্বালানিসংকট, আমদানি বিধিনিষেধ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা—এসব কিছুই আমাদের অর্থনৈতিক শ্লথতার অন্যতম কারণ। এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হার কি শুধু একটি উপাত্ত? আসলে, এ সংখ্যাটির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা আছে। সেই মাত্রাগুলো নিয়ে কিছু আলোচনা করা হলো এই লেখায়। 

শ্লথ প্রবৃদ্ধির প্রভাব অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদ বিষয়গুলো ছাপিয়ে বৃহত্তর পটভূমিতেও ব্যাপ্ত হয়। শ্লথ প্রবৃদ্ধি থেকে উদ্ভূত কর্মহীনতা এবং বৈষম্য থেকে সমাজে বিস্তৃত অসন্তোষ দেখা যায়

একটি শ্লথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হার সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর তিনভাবে প্রভাব ফেলে। এক. মূল্যস্ফীতির সঙ্গে শ্লথ প্রবৃদ্ধি মিলে সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে। তিন বছর ধরে মানুষের প্রকৃত আয় ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও কমে গেছে। হ্রাসকৃত প্রবৃদ্ধি তাদের অর্থনৈতিক দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেবে এবং সব দিকের তাল সামলাতে গিয়ে তারা হিমশিম খাবে। সত্যিকার অর্থে হ্রাসকৃত আয়ের কারণে দেশের ১০ শতাংশ বা দেড় কোটি মানুষ চরম নাজুক অবস্থায় থেকে নতুন করে দারিদ্র্যফাঁদে পড়ে যেতে পারে।

দুই. যাঁরা শ্রমবাজারে আছেন, শ্লথ প্রবৃদ্ধির কারণে তাঁদের কাজের সম্ভাবনা কমে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের তিন কোটি মানুষ কর্মহীন এবং শ্লথ প্রবৃদ্ধির কারণে এ সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিশেষ একটি চিন্তার জায়গা হচ্ছে তরুণদের কর্মহীনতা, যাঁদের মধ্যে বর্তমান বেকারত্বের হার হচ্ছে ১৮ শতাংশ। এ সবকিছু মিলে জনসংখ্যার এক বিরাট অংশের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে এবং তাঁদের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাবে।

অর্থনৈতিক শ্লথগতির কারণে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বর্তমানের বৈষম্য আরও বেড়ে যেতে পারে। কারণ, একটি অর্থনৈতিক শ্লথগতির বৈরী চাপ ধনিক গোষ্ঠীর চেয়ে দরিদ্র মানুষের ওপর বেশি পড়ে। অর্থনৈতিক শ্লথগতির কালে আয়, ভোগ ও জীবনযাত্রার মানক্ষেত্রে নিজেদের সুরক্ষিত করার ব্যাপারে ধনিক শ্রেণির যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকে, দরিদ্র মানুষের তা থাকে না। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান ব্যাপক। একটি শ্লথ প্রবৃদ্ধি এই ফারাককে আরও বাড়িয়ে দেবে।

হ্রাসকৃত বিনিয়োগ যেমন একদিকে শ্লথ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলাফল, তেমনি এটি অর্থনৈতিক শ্লথগতির কারণও হতে পারে। অর্থনৈতিক শ্লথগতি বেসরকারি বিনিয়োগকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এবং সেই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকেও আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় না। গত বছরের অক্টোবর মাসে বেসরকারি খাতে দেওয়া ঋণ ৮ শতাংশ হ্রাস পায়।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ ২০০ কোটি ডলার থেকে ১৫৯ কোটি ডলারে হ্রাস পায়। উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য যে ঋণপত্র খোলা হয়, তার পরিমাণ ২৭ শতাংশে নেমে এসেছে এবং উৎপাদনপ্রক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমিক দ্রব্যসামগ্রীর আমদানি ১৬ শতাংশ কমেছে। এসবের মানে হচ্ছে দেশের শিল্প উৎপাদনের শ্লথ প্রবৃদ্ধি আরও গভীর সংকট সৃষ্টি করবে।

শ্লথ প্রবৃদ্ধি সরকারের সম্পদ আহরণের প্রচেষ্টাকেও বাধাগ্রস্ত করবে। হ্রাসকৃত প্রবৃদ্ধির ফলে সম্পদের লভ্যতা কমে যাবে, যার কারণে দেশের অর্থনৈতিক এবং মানব উন্নয়ন তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক. শ্লথ প্রবৃদ্ধির কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় করের ভিত্তিটি সংকুচিত হয়ে পড়বে। দুই. সম্পদভিত্তিটি সংকুচিত হয়ে পড়লে ঋণ পরিশোধ এবং সুদ পরিশোধের ব্যাপারটি হুমকির সম্মুখীন হবে। ২০২৪ সালের শেষে বাংলাদেশের মোট ঋণভার ছিল ১৮ লাখ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরে সরকার এক লাখ কোটি টাকা সুদ পরিশোধের জন্য ব্যয় করেছে, যা জাতীয় বাজেটের এক-ষষ্ঠাংশ। বৈদেশিক ঋণের অন্য আরেকটি মাত্রা আছে। সুদ পরিশোধ করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। ফলে অনেক সময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের ওপর চাপ পড়ে। এ সবকিছুকে অতিক্রম করার জন্য ত্বরান্বিত প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন। তিন. প্রবৃদ্ধি হ্রাসের ফলে সম্পদ কমে গেলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পুষ্টির মতো সামাজিক সেবা খাতের জন্য ব্যয় কমে যায়। তেমনিভাবে সম্পদ হ্রাসের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ উন্নয়ন কিংবা নারীর ক্ষমতায়নের মতো প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেওয়া যায় না। 

শ্লথ প্রবৃদ্ধির প্রভাব অর্থনৈতিক এবং মানবসম্পদ বিষয়গুলো ছাপিয়ে বৃহত্তর পটভূমিতেও ব্যাপ্ত হয়। শ্লথ প্রবৃদ্ধি থেকে উদ্ভূত কর্মহীনতা এবং বৈষম্য থেকে সমাজে বিস্তৃত অসন্তোষ দেখা যায়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টির মতো বিষয়গুলোতে হ্রাসকৃত ব্যয় সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনকে বিপর্যস্ত করে। ফলে সামাজিক একটি টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে জলবায়ু পরিবর্তন এবং নারী-পুরুষের সমতার মতো বিষয়গুলোকেও পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া যায় না। 

সুতরাং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপাত্ত শুধু নিছক একটি সংখ্যা নয়, এর একটি বিস্তৃত পটভূমিসহ ব্যাপ্ত একটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রিকতা আছে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রশ্নে প্রাক্কলনকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র