বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গতিপথ কী হবে

‘বাংলাদেশবিরোধিতা’ এখন কেবল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের সব দলের ক্ষেত্রেই কমবেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি নিয়ে লিখেছেন সৈয়দা লাসনা কবীরমোহাম্মাদ ঈসা ইবনে বেলাল

গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনকে ভারতের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে গেছে। ফলে বিগত ১৬ বছরে দুই দেশের মধ্যে তথাকথিত বন্ধুত্বের যেসব উপাদান বিদ্যমান ছিল, এখন তার অধিকাংশই অনুপস্থিত।

শেখ হাসিনার আকস্মিক পতন ভারতের জন্য একটি বড় ধরনের ধাক্কা। বিগত বছরগুলোতে ভারতের বাংলাদেশবিষয়ক পররাষ্ট্রনীতির গতিপ্রকৃতি আওয়ামী লীগকে ঘিরেই সাজানো হয়েছিল। কারণ, ভারত হয়তো বিশ্বাস করে, তার আঞ্চলিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি যত্নশীল।

দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তা আদান-প্রদানকে উপেক্ষা করা গেলেও সরকারিভাবে ভারত তার নীতি ও পদক্ষেপে স্পষ্টতই বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানের দিকে এগোচ্ছে।

৫ আগস্ট–পরবর্তী সম্পর্কের টানাপোড়েন

এবারের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে, তা ঐতিহাসিকভাবে খুবই বিরল। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এতটা শীতল ছিল না। সেই সময়ে ভারত কোনো ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, বাণিজ্যেও বাধা সৃষ্টি করেনি। এমনকি ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়েও এমন বৈরী পরিস্থিতি দেখা যায়নি।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ভারত বাংলাদেশের প্রতি একধরনের নিষেধাজ্ঞার পথে এগোচ্ছে। ভিসাপ্রক্রিয়া প্রায় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসাপণ্য রপ্তানি বাধার মুখে পড়ছে। সম্প্রতি দিল্লির অটো পার্টস মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে গাড়ির যন্ত্রাংশ রপ্তানি সাময়িকভাবে স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই বর্জনে প্রায় দুই হাজার দোকান অংশ নিয়েছে, যারা নিয়মিতভাবে বাংলাদেশে গাড়ির যন্ত্রাংশ রপ্তানি করত।

বাংলাদেশের পরিবহন খাতে এই বর্জনের উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা যায়। কেননা, গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য ভারত থেকে আমদানি করা যন্ত্রাংশের ওপর বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এই খাতে বাংলাদেশ ভারত থেকেই সবচেয়ে বেশি আমদানি করে থাকে।

সাম্প্রতিক কালে মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশে অবৈধ বাংলাদেশিদের আটক এবং তাঁদের জন্য ‘সেফ হোম’ স্থাপনের কথাবার্তা চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব পদক্ষেপ ভারত সরকারের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ, যা ভারতের জনগণের মধ্যেও বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

ভারতের শাসকগোষ্ঠীর বাংলাদেশবিরোধিতার কারণ

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে একটি শক্ত বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নির্বাচনে জয়লাভের একটি কার্যকর হাতিয়ার। বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বিশেষভাবে লাভজনক। এই প্রচারণা প্রাদেশিক নির্বাচনে হিন্দু ‘ভোট ব্যাংক’ আকর্ষণে বড় ভূমিকা পালন করে। সুতরাং এ বিষয়ে যে দল যত বেশি সক্রিয়, তারা তত বেশি ভোটারকে নিজেদের পক্ষে আনতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা যায়।

২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিজেপি বিগত নির্বাচনে অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সেখানে জয়লাভ করতে পারেনি। ২০২৫ সালজুড়ে তারা বাংলাদেশ ইস্যুকে তাদের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। তারা যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘বাংলাদেশপ্রেমী’ বা ‘মুসলিমপ্রেমী’ হিসেবে তুলে ধরতে পারে, তবে তাঁকে কোণঠাসা করা অনেক সহজ হতে পারে। ফলে এটি বিজেপিকে দাবি করার সুযোগ দেবে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দুদের কল্যাণে তেমন গুরুত্ব দেন না। এর ফলে তারা ভাবছে, ভোটারদের মধ্যে বিজেপির অবস্থান আরও শক্তিশালী হতে পারে।

অন্যদিকে যদি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও খারাপ হয়, তবে এর অর্থনৈতিক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে পশ্চিমবঙ্গে। এই পরিস্থিতি বিজেপিকে নির্বাচনের মাঠে একটি নতুন সুযোগ এনে দেবে। তারা পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবনতি, ব্যবসায়িক ক্ষতি ও চিকিৎসা পরিষেবার দুর্বলতার জন্য সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করতে পারবে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন, যা কেন্দ্রীয় বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে খুবই সুবিধাজনক হতে পারে।

বিজেপি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে এই ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সাফলতাও পাচ্ছে, ফলে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসসহ অন্যান্য দলও অনেক সময় নিরপেক্ষ অবস্থান না নিয়ে মনগড়া বক্তব্য দিতে বাধ্য হচ্ছে। যদিও তারা জানে, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিষয়ে প্রচারিত অধিকাংশ তথ্য অতিরঞ্জিত বা মিথ্যা। তবু রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণায় জড়িয়ে পড়ছে।

গত সেপ্টেম্বরে রাহুল গান্ধী বাংলাদেশের উগ্রবাদ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন, আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দুদের রক্ষায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা বাহিনী পাঠানোর আহ্বান জানান। অপর দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সীমান্তে আরও কঠোর নজরদারির নির্দেশ দেন। এগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সব দলের সমর্থন ক্রমে বৈরিতার দিকে এগোচ্ছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও সব রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানে একমত।

অপর দিকে আমাদের দেশে ধারণা করা হয় যে ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী যদি বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান নেয়, তবে তারা অর্থনৈতিকভাবে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই ধারণা আংশিকভাবে সত্য। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান ভারতের জন্য রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও এটি তাদের জন্য তেমন বড় ক্ষতির কারণ নয়।

উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে ভারত সারা পৃথিবীতে ৭৭৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে, যেখানে বাংলাদেশে তাদের রপ্তানি মাত্র ১৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ভারতের রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশের কম। বাংলাদেশে যদি ভারতের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়, তবু ক্ষতির পরিমাণ ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে না। এই সামান্য ক্ষতি ভারত সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে; বরং বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান থেকে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো যে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করবে, তা তাদের জন্য এই ক্ষতির তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্ভাব্য পররাষ্ট্রনীতি

বাংলাদেশবিরোধিতা এখন আর কেবল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি ভারতের সমন্বিত পররাষ্ট্রনীতির একটি অংশে পরিণত হয়েছে। ভারত ক্রমান্বয়ে এমন একটি নীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যা পাকিস্তানের প্রতি তাদের কঠোর অবস্থানের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনো সেই মাত্রার কঠোরতা দেখা যায়নি, তবে ভারতের সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, শিগগিরই তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী নয়।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে তীব্র বিরোধ থাকলেও পাকিস্তান, চীন এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তাদের নীতি প্রায় একই। সংসদ চলাকালে বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটে; কিন্তু তারা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ঐকমত্য বজায় রাখে। বাংলাদেশের বিষয়েও একই ধরনের সমন্বিত পররাষ্ট্রনীতি দেখা যাচ্ছে, যা ভারতের জন্য স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত।

অপর দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় দুর্বলতা হলো জাতীয় ঐক্যের অভাব। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভারতের প্রতি অবস্থান কী এবং ভবিষ্যতে যদি কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে বা বিরোধী দলে থাকে, তখন তাদের ভারতের প্রতি অবস্থান কী হবে—এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্পষ্ট ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে না।

ভারতের পররাষ্ট্রনীতির আরেক বড় শক্তি হলো তাদের অভিবাসীরা। এটি তাদের একটি ‘সফট পাওয়ার’। প্রায় দেড় শ কোটি মানুষের দেশ হওয়ায় পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই তাদের অভিবাসী রয়েছে। তারা সেসব দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের কথা বলা যেতে পারে। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনেও পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার পূর্বসূরিরা ছিলেন ভারতীয়।

এই সফট পাওয়ার ভারতের জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বড় সুবিধা প্রদান করছে। এটি বাংলাদেশবিরোধী কূটনৈতিক প্রচারণাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করে তুলতে ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা যায়।

বাংলাদেশের জন্য করণীয়

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের শুরুর দিকে নির্বাচনের আয়োজন করবে। তাই আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কী রকম হবে বা এই সম্পর্ক কীভাবে বজায় রাখা হবে, সে বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের দিক থেকে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, তা অনেকটাই পরিষ্কার। তারা পাকিস্তানের সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক রাখছে, বাংলাদেশকেও একই ধরনের সম্পর্কের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ বা ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী রাষ্ট্র’ হিসেবে চিত্রিত করার জন্য তারা আনুষ্ঠানিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। এই চেষ্টা ধীরে ধীরে আরও বাড়তে পারে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট, তারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে না, যতক্ষণ না এখানে একটি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করছে।

বাংলাদেশের উচিত আগামী কয়েক বছর ভারতের ‘সফট পাওয়ার’ এবং প্রচারণার বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করা। ভারতের বাংলাদেশবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির মোকাবিলায় কী ধরনের নীতি গ্রহণ করা হবে, তা এখনই ঠিক করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কি ভারতবিরোধী পাল্টা পররাষ্ট্রনীতি নেবে, নাকি অন্য কোনো কৌশল অবলম্বন করবে, তা নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি সম্ভাব্য কৌশল হতে পারে এ দেশের নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রতি সমর্থন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা। এ দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয় এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তা আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করা। পাশাপাশি বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করা যেতে পারে।

ভারতের ওপর নির্ভরশীল আমদানি পণ্য বিকল্প রাষ্ট্র থেকে আমদানির ব্যবস্থা করা জরুরি। এর জন্য বাংলাদেশের একটি কার্যকর ‘অলটারনেটিভ সাপ্লাই চেইন’ কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যা ভারতের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আরও যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারে, তা হলো, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং গ্লোবাল ব্র্যান্ডিংকে কাজে লাগানো। তাঁর এই গ্লোবাল প্রভাব ব্যবহার করে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি সারা বিশ্বে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে। এটি ভারতের সফট পাওয়ারকে দুর্বল করার পাশাপাশি তাদের আন্তর্জাতিক প্রচারণার বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, আমলা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ঐক্য থাকা আবশ্যক। ভারতের মতো বড় দেশ, যারা জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে বাংলাদেশ থেকে বহুগুণ এগিয়ে, তাদের মোকাবিলায় একটি ঐক্যবদ্ধ কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

এখন পর্যন্ত ভারতের বৈরিতা মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি খুবই স্বল্প। শান্তি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের এখনই একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সম্ভাব্য যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিকল্প পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ কখনোই ভারতের সঙ্গে বৈরিতা চায় না। তবে ভারতের বৈরী আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, তা নিয়ে দল-মতনির্বিশেষে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ও কর্মপরিকল্পনা থাকা জরুরি। সব ক্ষেত্রেই একটি দৃঢ় জাতীয় ঐক্য এখন দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি অপরিহার্য।

  • সৈয়দা লাসনা কবীর অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • মোহাম্মাদ ঈসা ইবনে বেলাল গবেষণা সহযোগী, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়