বর্তমানে জার্মানি ও ইউরোপে নব্য নাৎসি বা কট্টর জনতুষ্টিবাদীদের মূল জনপ্রিয় স্লোগান হলো, ‘শরণার্থী আর অভিবাসী হটাও’। একসময় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীরা শত বছরের বেশি সময় ধরে এশিয়া ও আফ্রিকার নানা দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। তারা এসব দেশে পরোক্ষভাবে যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধে মদদ দিয়ে সেখানকার মানুষকে গৃহহারা করেছে। অথচ এখন তারা শরণার্থী ও অভিবাসীদের রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে ইউরোপে রাজনীতি করছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, অ্যাডলফ হিটলারের গঠিত ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মান শ্রমিক দল’ (এনএসডিএপি) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই দলের আদর্শ ও কর্মসূচি ছিল উগ্র জাতিবিদ্বেষ, জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র ও প্রগতিশীল দলগুলোর বিরোধিতা। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দলটি জার্মানির একমাত্র অনুমোদিত দল ছিল এবং তথাকথিত তৃতীয় রাইখের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল।
প্রায় ৮০ বছর পর জার্মানির ২১তম জাতীয় নির্বাচনে সেই আদর্শের অনুসারী কট্টরপন্থীরা বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে। জার্মান পার্লামেন্টের ৬৩০টি আসনের মধ্যে নব্য নাৎসি কট্টরবাদী দল অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) ১৫২টি আসন পেয়েছে। যদিও তারা সরকার গঠন করতে পারবে না, তবে দলটি পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।
নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন জার্মানিজুড়ে অভিবাসনবিরোধী দলটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা গণতান্ত্রিক দলগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা এএফডির সঙ্গে কোনো ধরনের জোট গঠন না করে। তবে এসব প্রতিবাদ সত্ত্বেও দলটির উত্থান ঠেকানো যায়নি।
জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার করোনা-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সমস্যা ও মুদ্রাস্ফীতি, তিন দলের জোটের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার অভাব, জলবায়ু নীতি নিয়ে বিতর্ক এবং নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ—এসব কারণে শলৎজের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে।
নির্বাচনের পর ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) নেতা ফ্রিডরিখ মের্ৎস জার্মান অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি নির্বাচনী প্রচারে প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
চার বছর আগে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের নেতা ও সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ওলাফ শলৎজের নেতৃত্বে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, গ্রিন পার্টি ও ফ্রি ডেমোক্র্যাট পার্টি মিলে তিন দলীয় জোট সরকার গঠন করে। তবে জোটের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের ফলে ২০২৪ সালের নভেম্বরে ফ্রি ডেমোক্র্যাট পার্টি সরকার থেকে বেরিয়ে গেলে ওলাফ শলৎজের সরকার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। এই কারণেই জার্মানির ২১তম জাতীয় নির্বাচন ছয় মাস এগিয়ে আনা হয়।
নির্বাচনের সর্বশেষ ফলাফল অনুযায়ী, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ ও সিএসইউ) ২০৮টি আসন, অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) ১৫২টি আসন, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি) ১২০টি আসন, গ্রিন পার্টি ৮৫টি আসন এবং বাম দল দ্য লিংকে ৬৪টি আসন পেয়েছে।
এএফডির উত্থানের পেছনে জার্মানির দুই প্রধান দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির ভুল নীতি কাজ করেছে। শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ে তাদের অবস্থান অনেক সময় অস্পষ্ট ছিল। নির্বাচনের আগে ডিসেম্বরে মাগডেবুর্গে একজন সৌদি নাগরিকের ক্রিসমাস মার্কেটে হামলা এবং নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে একজন আফগান নাগরিকের হামলা কট্টরপন্থীদের অভিবাসনবিরোধী প্রচারকে আরও জোরদার করেছে। অর্থনৈতিক সংকট ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি দলটির জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে।
বর্তমানে জার্মানির বড় অংশ এএফডিকে একটি ‘স্বাভাবিক’ দল হিসেবে দেখছে। জরিপে দেখা গেছে, এএফডির সমর্থকেরা অভিবাসীদের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
সম্প্রতি জার্মান অর্থনৈতিক ইনস্টিটিউট (আইডব্লিউ) একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৫ থেকে ২০২৩ সময়কালে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। ফলে রপ্তানি এখন আর জার্মান অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি নয়। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, যা জার্মানির অর্থনীতির দুর্বলতার অন্যতম কারণ।
নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য ক্ষমতাসীন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের লজ্জাজনক হস্তক্ষেপ লক্ষ করা গেছে। প্রযুক্তি ধনকুবের ইলন মাস্ক এএফডির পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান এবং দলটির নেত্রী অ্যালিস ভায়ডেলের সঙ্গে কথোপকথনের একটি অডিও শেয়ার করেন। জার্মান রাজনীতিবিদরা একে নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও গ্রিন পার্টি একটি শক্তিশালী জোট সরকার গঠনের পরিকল্পনা করছে। সম্ভাব্য নতুন চ্যান্সেলর হতে যাচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের নেতা ফ্রিডরিখ মের্ৎস। এখন দেখার বিষয়, নতুন সরকার জার্মানির চলমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে দেশকে কতটা এগিয়ে নিতে পারে।
সরাফ আহমেদ
প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
Sharaf.ahmed@gmx.net