বিজয়ের মাস
একাত্তরের রণাঙ্গনে প্রাণপণ লড়াই
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয়ে নানা ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছিল। হাফিজ উদ্দিন আহমদ রণাঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ের আরও কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর লেখা সৈনিক জীবন: গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। ১ ডিসেম্বর বিজয়ের মাসের প্রথম দিন উপলক্ষে তাঁর সেই বই থেকে চুম্বক অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।
২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন মিডিয়াম কামানের সহায়তা নিয়ে কাগজপুকুরের ওপর আক্রমণ চালায়। আমাদের রক্ষণব্যূহের সামনে ইপিআরের দুই কোম্পানি, পেছনে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের দুই কোম্পানি। ইপিআর সৈনিকেরা মুহুর্মুহু কামানের গোলার আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। হাবিলদার মুজিবুর রহমান বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শত্রুর ব্যাপক ক্ষতি করে শহীদ হন। তাঁকে মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়।
কাগজপুকুরে দীর্ঘ সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে ঠেকানো সম্ভব ছিল না। আমার প্ল্যান ছিল শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে পিছিয়ে এসে আবার রক্ষণব্যূহ গড়া। ১ম ইস্ট বেঙ্গলের দুই কোম্পানি বেনাপোল চেকপোস্টের এক কিলোমিটার পূর্বে নতুনভাবে ডিফেন্স নেয়। সৈনিকদের নির্দেশ দিলাম, মাতৃভূমির এই ক্ষুদ্র অংশটুকু জীবনের বিনিময়েও রক্ষা করতে হবে। বেনাপোল চেকপোস্টে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে, পৃথিবীর বহু দেশে টেলিভিশনের মাধ্যমে এ দৃশ্য সবাই দেখছে। পাকিস্তান সরকার স্থানীয় কমান্ডারকে আদেশ দিয়েছে এ পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনের জন্য।
গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড মাঝখানে রেখে আমাদের দুটি কোম্পানি বাংকার খুঁড়ে শক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। প্রতিদিন পাকিস্তানি বাহিনী কামানের সাহায্য নিয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করে, আমরা প্রতিটি আক্রমণ সফলভাবে প্রতিরোধ করি। লে. মেঘ সিংকে অনুরোধ করে ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার সংগ্রহ করি তাঁর কাছ থেকে। আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হয়।
এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যোদ্ধাদের পক্ষে এলাকা রক্ষা করা খুব কঠিন নয়। আমরা মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছি। প্রতিদিন শেলের আঘাতে আমাদের পক্ষে হতাহত হচ্ছে কিন্তু শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। মহাসড়কের ওপর রয়েছে শতবর্ষী বিশাল বৃক্ষরাজি, যা আমাদের কামানের গোলা থেকে কিছুটা প্রটেকশন দেয়।
ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বীরোচিত সংগ্রামের কথা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী জনমত সংগঠিত হয় স্বাধীনতার সপক্ষে। পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকদের কয়েকজন লন্ডন, ওয়াশিংটন, কলকাতা, দিল্লি, বাগদাদ প্রভৃতি স্থানে বিদ্রোহ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে তাদের অত্যাচার-নির্যাতন ব্যাপকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে নিরীহ মানুষ হত্যা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী নির্যাতন করে পাকিস্তানি সেনারা এক নারকীয় তাণ্ডব সৃষ্টি করে। প্রায় এক কোটি নির্যাতিত মানুষ প্রাণভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। সে দেশের সরকার তাঁদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। শরণার্থীদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে।
হাজার হাজার ছাত্র-যুবকের দল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে। তাদের দেওয়ার মতো অস্ত্র আমাদের নেই। ভারত সরকার সমরাস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে তখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। সীমান্তে ছাত্র-যুবকদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বহু ইয়ুথ ক্যাম্প। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন গ্রামীণ যুবকেরা। অস্ত্র ও ট্রেনিং পেলেই তাঁরা গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
...মুক্তিবাহিনীতে অফিসারের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। ফলে অপারেশন পরিচালনা আশানুরূপ হচ্ছিল না। শিক্ষিত ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের পর কমিশন প্রদান করে এ ঘাটতি পূরণের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর ছাত্র-যুবকদের কয়েকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে।
এদের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেধাবী ছাত্ররাও ছিল। এরা অত্যন্ত সাহসী, দেশপ্রেমিক, পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এরাই ছিল প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, যাদের কাছে স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করা নিতান্তই সহজ-সরল একটা কর্তব্য। ছাত্র-যুবকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছিল, সে সময় এসব দামাল ছেলে পরিবার-পরিজনের আশ্রয় ছেড়ে অনিশ্চয়তার বিপৎসংকুল পথে স্বপ্রণোদিত হয়ে পাড়ি জমিয়েছে।
ভারতের উত্তরাঞ্চলে ভুটান সীমান্তের কাছাকাছি মূর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা যুবকদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ভারতীয় সেনা অফিসাররা সেখানে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিন মাস প্রশিক্ষণের পর ৬৪ জন যুবককে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন দেওয়া হয়। পাসিং আউট প্যারেডে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সালাম গ্রহণ করেন। ক্যাডেট সাইদ আহমদ* সেরা ক্যাডেট বিবেচিত হয় এবং সি-ইন-সির কেইন অর্জন করে।
অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত দুজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওয়াকার এবং আনিস আমাদের পল্টনে যোগ দেয়। বৃহত্তর সিলেটে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা আশানুরূপ ছিল না। চা-বাগানসমূহ পূর্ণোদ্যমে উৎপাদন করছিল এবং পাকিস্তান সরকার চা রপ্তানি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছিল, যা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
চা-বাগানসমূহ রেইড করে চা উৎপাদন বন্ধ করার পরিকল্পনা করা হলো। এক সপ্তাহের মধ্যে রেইড করে আমরা চম্পারায়, খাজুরী ও পাত্রখোলা চা-বাগানের মেশিনপত্র এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে ধ্বংস করি। চা-বাগান এলাকা গেরিলা অপারেশনের জন্য সুবিধাজনক, কিন্তু সেখানে চলাফেরার জন্য গাইডের প্রয়োজন। চা-বাগানের লেখাপড়া না জানা শ্রমিকদের কয়েকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের রেইড পার্টির গাইডের দায়িত্ব পালন করে। তাদের মধ্যে গুতনাবের নামক এক শ্রমিক শত্রুর গুলিতে নিহত হয়। তারপরও তারা বিপৎসংকুল দায়িত্ব পালনে কুণ্ঠাবোধ করেনি। তাদের দেশপ্রেম দেখে শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়ে আসে।
অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহের এক বিকেলে আমরা শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটির ওপর রেইড করার উদ্দেশে রওনা হই। সঙ্গে একটি প্লাটুন এবং ডাক্তার মুজিব। গাইড পাত্রখোলা চা-বাগানের শ্রমিক হরি। শীর্ণদেহ, কোঁকড়া চুল, বোকাসোকা চেহারা। মুখে শিশুর মতো মিষ্টি হাসি লেগেই আছে। সীমান্ত অতিক্রমের পূর্বমুহূর্তে খবর এল হরির আসন্নপ্রসবা স্ত্রী শরণার্থী ক্যাম্পে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হরিকে ডা. মুজিবসহ পাঠালাম ক্যাম্পে। ঘণ্টা দুয়েক পর মুজিব এসে জানাল, হরির স্ত্রী একটি মৃত সন্তান প্রসব করে মারা গেছে। শুনে দুঃখ পেলাম।
অপারেশন সম্পন্ন করার জন্য উদ্বিগ্ন হলাম। হরিকে ছাড়া চা-বাগানের মধ্য দিয়ে শ্রীমঙ্গল যাওয়া সম্ভব হবে না, আবার শোকাভিভূত হরিকে আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলতেও পারছি না। কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতে হরি এসে উপস্থিত হলো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম শ্রীমঙ্গলে যাওয়ার জন্য অন্য কোনো গাইড পাওয়া যাবে কি না। চোখ মুছে হরির উত্তর, ‘সাব, বউ মরছে তো কী হইছে? আমিই আপনাগো লইয়া যামু শ্রীমঙ্গল। কোনো চিন্তা করবেন না।’
অবাক হয়ে গেলাম একজন সাধারণ শ্রমিকের দেশাত্মবোধের পরিচয় পেয়ে। সেই অন্ধকার রাতে চা-বাগানের ভেতর দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে একটি সফল রেইড করে নির্বিঘ্নে ফিরে এলাম আমরা। বেস ক্যাম্পে ফিরে আসার পর তাকে অনুরোধ করলাম আমাদের সঙ্গে থেকে যেতে, কিন্তু হরি রাজি হলো না। সে চলে গেল অজানার উদ্দেশে, আর তার কোনো পিছুটান নেই।
এ অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ধলই বিওপি। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈন্য কংক্রিট বাংকারে রক্ষণব্যূহ গড়ে তুলেছে। কামালপুরের মতোই মাইন ফিল্ড ও কাঁটাতারের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেখানে। কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগত সিং ‘সি’ কোম্পানি নিয়ে বিওপি আক্রমণ করতে নির্দেশ দিলেন। ব্রাভো কোম্পানি নিয়ে ধলইয়ের দুই মাইল দক্ষিণে পাত্রখোলা চা-বাগান এলাকায় আমি এবং ডেলটা কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী কমলগঞ্জ পাত্রখোলা সড়কের ওপর অবস্থান নেবে, যাতে শত্রুরা বিওপি এলাকায় রিইনফোর্সমেন্ট না পাঠাতে পারে।
২৮ অক্টোবর। প্ল্যান মোতাবেক ক্যাপ্টেন মাহবুবসহ সকালেই ব্রাভো কোম্পানি নিয়ে পাত্রখোলা চা-বাগান এলাকায় ডিফেন্স নিলাম। সঙ্গে রয়েছে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর মেজর চৌধুরী, বেতার সেট ও ১০ জন সৈনিকসহ। আধমাইল দূরে সড়কের ওপর ব্লক স্থাপন করে পাটোয়ারীর নেতৃত্বে ডেলটা কোম্পানি। পূর্বনির্ধারিত সময়ে আমাদের চার্লি কোম্পানি লে. কাইয়ুমের নেতৃত্বে ধলই বিওপির একটি অংশে ফিল্ডগানের সাহায্য নিয়ে আক্রমণ চালায়।
শত্রু দৃঢ়তার সঙ্গে সে আক্রমণ প্রতিহত করে। সংঘর্ষে আমাদের পক্ষে নায়েব সুবেদার ইব্রাহিম, ইউসুফ, হাবিলদার সোবাহানসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়। একপর্যায়ে শত্রু পাল্টা আক্রমণ চালায় চার্লি কোম্পানির ওপর। সিপাহি হামিদুর রহমান মেশিনগান নিয়ে শত্রুর ওপর অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করে তাদের ঠেকিয়ে রাখে এবং আমাদের একটি প্লাটুনকে পিছিয়ে আসার সুযোগ করে দেয়। বেশ কয়েকজন শত্রুসেনা তার গুলিতে নিহত হয়। কিন্তু অসামান্য বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে এই সাহসী তরুণ মৃত্যুবরণ করে। পরে তাকে সর্বোচ্চ সাহসিকতা পুরস্কার ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
আমরা পাত্রখোলা বাগানে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে আছি শত্রুসৈন্যদের দেখা পাওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের সাড়াশব্দ নেই। আমরা দুই দিন চালানোর মতো শুকনা খাবার নিয়ে এসেছি। মেজর চৌধুরী গোলন্দাজ বাহিনীর ফরোয়ার্ড অবজারভেশন অফিসার, ম্যাপে শত্রুর আগমন-নির্গমনের পথ চিহ্নিত করে রেখেছেন। আমি নির্দেশ দিলে চৌধুরী ম্যাপের গ্রিড রেফারেন্স বেতারযোগে গান পজিশনে পাঠাবেন। মিডিয়াম কামানের গোলা নিক্ষিপ্ত হবে সঙ্গে সঙ্গেই। ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করার পর শত্রুর দেখা না পাওয়ায় মাহবুবকে এক সেকশনসহ (১০ জন) ধলইয়ের দিকে পাঠালাম। সে আধা মাইল উত্তরে একটি কালভার্টের আড়ালে অ্যাম্বুশ পাতে। কিছুক্ষণ পর গোলগুলির শব্দ পেলাম। কালো পোশাক পরা সাত-আটজন সৈনিক কাছাকাছি এলে মাহবুবের এলএমজি গর্জে ওঠে। তিনজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়, বাকিরা উল্টো দিকে পালিয়ে যায়। একজন আহত সুবেদার মাটিতে শুয়ে কাতরাতে থাকে।
আমাদের সৈনিকেরা তাকে বহন করে পাত্রখোলায় আমাদের অবস্থানে নিয়ে আসে। আহত পাঠানের নাম গুল চমন (বাগানের ফুল)—দেখতে রোগাপটকা। প্যারা মিলিটারি ফ্রন্টিয়ার কনস্টবুলারির জেসিও। কিছুদিন আগেই তাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। তাদের সম্মুখযুদ্ধের প্রথম অভিজ্ঞতা আজই হয়েছে। মিডিয়াম কামানের গোলা বিকট শব্দে ফাটতেই তারা ভয় পেয়ে ডিফেন্স ছেড়ে পালাতে গিয়ে বিপদ ডেকে এনেছে। সে প্রাণভয়ে বলছে, ‘জয় বাংলা, বাংলাদেশ আজাদ হো জায়েগা’, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। ঘণ্টা দুয়েক পরই সে মৃত্যুবরণ করে।
বিকেলের দিকে এক কোম্পানি শত্রুসৈন্য সড়কের প্রতিবন্ধকতা সরানোর জন্য ডেলটা কোম্পানির ওপর আক্রমণ চালায়। ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী বেতারযোগে মেজর চৌধুরীকে গোলা ফেলার অনুরোধ জানালে তিনি গান পজিশনে যোগাযোগ করে শত্রুর ওপর বেশ কয়েক রাউন্ড গোলা ফেলেন। ফলে শত্রুর আক্রমণ ব্যর্থ হয়। তাদের একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ৪০ জন হতাহত হয়। রাতে পাকিস্তানি সেনারা বের হয় না, রাতটা নির্ঝঞ্ঝাটে কেটে গেল।
২৯ অক্টোবর, আমার জন্মদিন। ট্রেঞ্চে বসে মেজর চৌধুরীকে এ কথা জানাতেই আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন ‘হ্যাপি বার্থডে’।
‘ধন্যবাদ, দোয়া করবেন জন্মদিন যেন মৃত্যুদিনে পরিণত না হয়,’ বলার পর উভয়ের সম্মিলিত হাসি। গুড়, চিড়া আর পাহাড়ি নালার পানি দিয়ে জন্মদিনের ব্রেকফাস্ট সারলাম।...
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম, মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও মন্ত্রী