‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে,
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে;
যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার, তখনি সে
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে;
দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার,
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার মনে মনে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় এই ডাক দিয়ে গেছেন। অন্যায়কারী, জুলুমকারীরা মনের মধ্যে ঠিকই জানে, তারা অন্যায় করছে। কাজেই তারা ভীরু হয়। একবার মাথা তুলে একসঙ্গে তাদের সামনে দাঁড়াতে পারলেই হয়! তারা ধেয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, দাঁড়াতে হয় একত্রে। একা একা দাঁড়ালে হয় না। যদিও রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ সেই একলা চলাটা একলাই চলা হয়। সম্মিলিত প্রতিরোধের কাফেলায় তা পরিণত হয় না।
তখন আবারও রবীন্দ্রনাথ থেকেই পাঠ নিতে হয়:
‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’
এইভাবে একলা চলতে চলতে, বহু ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে, একটা সময় মানুষ মানুষকে জাগিয়ে তোলে। সম্মিলিত মানুষ যখন এগোতে থাকে, তখন তা বাঁধভাঙা স্রোত! তাকে আটকায় সাধ্য কার! অন্যায়কারী পালাবার দিশা পায় না।
কিন্তু ইতিহাসে সেই ঘটনা তো প্রতিদিন ঘটে না। প্রত্যেক দশকেও ঘটে না। আবার কত বিপ্লব-উপবিপ্লব-প্রতিবিপ্লবই তো দেখল পৃথিবী; কিন্তু মানুষের মুক্তি ঘটল কোথায়? অঞ্জন দত্তের গানে আছে, ‘সুদিন আনবে বলে ওরা আগুন জ্বালায়, আর হাজার হাজার মানুষ মরে যায়!’
মানুষের মুক্তি নেই। স্তরে স্তরে সে শিকলে বন্দী। তবুও প্রগতিশীলের কাজ ক্রমাগতভাবে খাঁচার বিরুদ্ধে, ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, প্রচলের বিরুদ্ধে, কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া।
মিশেল ফুকো যেমনটা ভাবেন, ‘ক্ষমতার হাত থেকে মুক্তি নেই, মানুষের সমাজ আর ক্ষমতা-ব্যবস্থা সহাবস্থান করে। আমরা শুধু একটা ব্যবস্থা থেকে আরেক ব্যবস্থায় যেতে পারি।’
এ অবস্থায় আমরা কী করব? নাগরিকেরা প্রতিবাদ করতে পারি, কিন্তু নাগরিকদের প্রতিবাদে কি ফল হয়? ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকায় প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়েছিল, অগণন মানুষ পথে বেরিয়ে এসেছিল, তাতে কী ফল হয়েছে? নোয়াম চমস্কিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘যাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁরা তো এখন হতাশায় ভোগেন, এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?’
চমস্কি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি এটাই বলব যে তাদের বাস্তববাদী হওয়া উচিত। দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের কথাই ধরুন, এই আন্দোলন সফলতার জন্য কত দীর্ঘ সময়ের সংগ্রাম চালাতে হয়েছিল। তাৎক্ষণিক ফলাফল পেতে ব্যর্থ হয়ে আপনি যদি প্রতিবারই আপনার প্রচেষ্টার হাল ছেড়ে দেন, তবে আপনাকে মনে রাখতে হবে আরও ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ সংগ্রাম।’
চমস্কি বলেছেন, ‘নাছোড়বান্দা হওয়া ছাড়া এ-যাবৎ কোনো আন্দোলনই সফলতার আলোর মুখ দেখেনি।’ (নোয়াম চমস্কির সাম্রাজ্যবাদীদের উচ্চাভিলাষ। অনুবাদ রফিকুল রনি। প্রকাশক নাগরী)।
২.
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন ২২ শ্রাবণ সামনে রেখে চ্যানেল আইয়ের ‘তৃতীয় মাত্রায়’ এ-সম্পর্কিত আলোচনায় গিয়েছিলাম। ফরিদুর রেজা সাগর প্রশ্ন করলেন, আজকের দিনে বেঁচে থাকলে রবীন্দ্রনাথ কী করতেন? তিনি কি সায়েন্স ফিকশন লিখতেন?
অনুষ্ঠানটাকে একটুখানি জমিয়ে তুলতেই ফরিদুর রেজা সাগর এই প্রশ্ন করে বসলেন। আমিও রসিকতার ছলে জবাব দিলাম, রবীন্দ্রনাথ এখন থাকলে ফেসবুকে সক্রিয় থাকতেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন, আর সেই ছবি চ্যানেল আইতে দেখানো হতো। তিনি তো সায়েন্স ফিকশন লিখেওছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের গল্প ‘ইচ্ছাপূরণ’। ‘সুবলচন্দ্রের ছেলেটির নাম সুশীলচন্দ্র। কিন্তু সকল সময়ে নামের মতো মানুষটি হয় না। সেই জন্যই সুবলচন্দ্র কিছু দুর্বল ছিলেন এবং সুশীলচন্দ্র বড়ো শান্ত ছিলেন না।’ সুবলচন্দ্র বালক বয়সে ফিরতে চান। আর সুশীল পেতে চায় বাবার বয়স। ইচ্ছাঠাকুরন যাচ্ছিলেন পাশ দিয়ে। তিনি ইচ্ছা পূরণ করে দিলেন। তাতে তারা কেউই শান্তি পেল না। শেষে আবার বাবা বাবার জায়গায় এবং ছেলে ছেলের জায়গায় ফিরে এলে।
এটাকে ফ্যান্টাসি বলা যাবে। সায়েন্স ফিকশন ঠিক নয়। তবে আইজাক আসিমভের গল্প দ্য ‘ইমমরটাল বার্ড’ বা ‘অমর কবি’ যদি সায়েন্স ফিকশন হতে পারে, তবে ‘ইচ্ছাপূরণ’ও সায়েন্স ফিকশনই। সে গল্পে পরে আসছি। তার আগে বলি, রবীন্দ্রনাথের ‘কর্মফল’ কবিতাটাই তো সায়েন্স ফিকশন:
‘পরজন্ম সত্য হলে
কী ঘটে মোর সেটা জানি—
আবার আমায় টানবে ঘরে
বাংলাদেশের এ রাজধানী।
গদ্য পদ্য লিখনু ফেঁদে,
তারাই আমায় আনবে বেঁধে,
অনেক লেখায় অনেক পাতক,
সে মহাপাপ করবে মোচন--
আমায় হয়তো করতে হবে
আমার লেখা সমালোচন।’
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, আরেকবার জন্ম হলে তিনি হবেন সমালোচক। আর কারও নয়, তাঁর নিজের লেখাগুলোর সমালোচনা করবেন। ভীষণ নিষ্ঠুর নিষ্করুণ সমালোচনা। এমনকি অভিযোগ তুলবেন চুরিরও।
‘বলব, এ-সব কী পুরাতন!/আগাগোড়া ঠেকছে চুরি।/মনে হচ্ছে, আমিও এমন/লিখতে পারি ঝুড়ি ঝুড়ি।’
একটা লোক কবিতা লিখলেন, বাংলা ছোটগল্প দাঁড় করালেন, গান লিখলেন, গাইলেন, উপন্যাস লিখলেন, ব্যাকরণ লিখলেন, প্রতিষ্ঠান গড়লেন, উন্নত গাভি আনালেন, আলু আনালেন, ক্ষুদ্র ঋণ চালু করলেন, নাটক লিখলেন, অভিনয় করলেন; কী করলেন না? আবার বিজ্ঞানের বইও লিখে ফেললেন। কী সর্বনাশা কথা! এই জন্যই তিনি রবীন্দ্রনাথ।
এখন আসি আসিমভের গল্পটিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ওয়েলচ দাবি করছেন, তিনি অনেক আগের মনীষীদের আবার ফিরিয়ে আনতে পারেন। ইংরেজির তরুণ শিক্ষক রবার্টসনের সঙ্গে তিনি এক ক্রিসমাস আসরে কথা বলছেন। ওয়েলচ বললেন, সত্যি কথা বলতে কি, আমি শেক্সপিয়ারকে ফিরিয়ে এনেও ছিলাম। তাঁকে তাঁর ওপরে লেখা বইগুলো থেকে একটা পড়তেও দিয়েছিলাম। তারপর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেক্সপিয়ার বিষয়ের ক্লাসে ভর্তিও করিয়ে দিয়েছিলাম।
রবার্টসন বলছেন, ওই ক্লাস তো আমি নিই। সে দেখতে কেমন?
ছবির মতো না। টাক বড়। গোঁফ আছে।রবার্টসন তখন বললেন, হ্যাঁ। এই রকম একজন ক্লাসে ছিল বটে।
ওয়েলচ বললেন, আসলে আমার ভুল হয়ে গিয়েছিল। আমি তাকে আবার ১৬০০ সালে ফিরিয়ে দিয়েছি।
কী ভুল? রবার্টসন বললেন।
তুমি তাকে ফেল করিয়ে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলে।
শেক্সপিয়ার-বিষয়ক ক্লাসে এসে শেক্সপিয়ার ফেল করেছিলেন। এই হলো আসিমভের গল্প। তবে রবীন্দ্রনাথ আবার এলে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করবেন এবং সেই সমালোচনা হবে ভীষণ কঠিন।
৩.
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে বিজ্ঞানীরা ১ হাজার ৩০০ কোটি বছরের আগের ছায়াপথগুলোর ছবি তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য মহাকাশ নিয়ে চমৎকার বই লিখেছিলেন। তাঁর বইটা শুরু করেছিলেন প্রমথনাথ সেনগুপ্ত। রবীন্দ্রনাথের হাত পড়ায় এটা রবীন্দ্রনাথের নামেই প্রকাশিত হয়। সেই বই থেকে খানিকটা:
‘কিছুকাল পূর্বে লাসেন্টা অর্থাৎ গোধিকা নামধারী নক্ষত্ররাশির কাছে একটি, যাকে বলে নতুন তারা, হঠাৎ অত্যুজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল। পরে পরে চারটে জ্যোতির খোলস দিলে ছেড়ে। দেখা গেল ছাড়া খোলস দৌড় দিয়েছে এক সেকেণ্ডে ২২০০ মাইল বেগে। এই নক্ষত্র আছে প্রায় ২৬০০ আলো-চলা বছর দূরে। অর্থাৎ এই যে তারার গ্যাস জ্বলনের উৎপতন আজ আমাদের চোখে পড়ল এটা ঘটেছিল খ্রীস্টজন্মের সাড়ে ছশো বছর পূর্বে।...এই যে তারা জ্বলে-ওঠা, এ ঘটনাকে বিচার করে কোনো কোনো পণ্ডিত বলেছেন হয়তো এমনি করেই নক্ষত্রের বিস্ফোরণ থেকে ছাড়া-পাওয়া গ্যাসপুঞ্জ হতেই গ্রহের উৎপত্তি; হয়তো সূর্য একসময়ে এইরকম নতুন তারার রীতি অনুসারে আপন উৎসারিত বিচ্ছিন্ন অংশ থেকেই গ্রহসন্তানদের জন্ম দিয়েছে।’
আজকে আমরা জেমস ওয়েব পাঠানো ছবি দেখে যা বলছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমথনাথ সেনগুপ্তর সঙ্গে মিলে বিশ্বপরিচয় নামে বইটিতে ১৯৩৭ সালেই তার চেয়ে সুন্দর করে অপরূপভাবে তা প্রকাশ করে গেছেন। একটা লোক কবিতা লিখলেন, বাংলা ছোটগল্প দাঁড় করালেন, গান লিখলেন, গাইলেন, উপন্যাস লিখলেন, ব্যাকরণ লিখলেন, প্রতিষ্ঠান গড়লেন, উন্নত গাভি আনালেন, আলু আনালেন, ক্ষুদ্র ঋণ চালু করলেন, নাটক লিখলেন, অভিনয় করলেন; কী করলেন না? আবার বিজ্ঞানের বইও লিখে ফেললেন। কী সর্বনাশা কথা! এই জন্যই তিনি রবীন্দ্রনাথ। লাইট ইয়ারের বাংলা পরিভাষা আলো-চলা বছরটাই কিন্তু ভালো ছিল। রবীন্দ্রনাথ তৎসমের বদলে মুখের ভাষাকে যে বেশি পছন্দ করতেন!
আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক