সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মী আহসানুল হকের কাছে জানতে পারি, রংপুরের আলাইকুমারী নদীর ওপর আড়াআড়িভাবে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর কথা শুনে কালক্ষেপণ না করে নদীটির সেই স্থান দেখতে গেলাম। রংপুরের মাহিগঞ্জ এলাকা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ইন্ডিয়াপাড়া গ্রাম। সেই গ্রামে আলাইকুমারী নদীতে আড়াআড়িভাবে নির্মিত হয়েছে সড়ক। যখন ইন্ডিয়াপাড়া পৌঁছালাম, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ৪০ দিনের কর্মসূচির শ্রমিকদের দিয়ে নদীর ওপর আড়াআড়িভাবে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি টাকায় নদীটাকে মেরে ফেলার সব আয়োজন সম্পন্ন।
স্থানীয় লোকজন জানান, সেখানে একটি সেতু ছিল। আমিও লক্ষ করলাম, একটি সেতুর শেষচিহ্ন কোথাও কোথাও আছে। নতুন একটি সেতু নির্মাণ করার জন্য পুরোনো সেতুটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। জয়নাল নামের এক ব্যক্তি জানান, নতুন সেতু করার জন্য রড, সিমেন্ট, বালুসহ যাবতীয় জিনিস আনা হয়েছিল। পরে সেসব ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেতুটির কাজ শুরু হয়নি। পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আলম মুঠোফোনে জানান, পানিপ্রবাহ বেড়ে গেলে সড়ক ভেঙে দেওয়া হবে। এলজিইডি ছোট মাপের সেতু করতে চেয়েছিল। নদী রক্ষা কমিশনের আপত্তির কারণে সেটি হয়নি। এখন বড় সেতু হবে।
আড়াআড়ি সড়ক থাকলে পরবর্তী সময়ে সেখানে আর সেতু না-ও হতে পারে। এর চেয়েও বড় বড় নদীতে সেতুবিহীন আড়াআড়ি সড়ক করার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। বরং কাঁচা সড়কটুকু হয়তো একদিন পাকা হবে। এভাবেই মরে যেতে পারে আলাইকুমারী নদীটি।
জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সম্পত্তি রক্ষা করবেন। কোথাও পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে সেটি বাধাহীন করবেন। সেই জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নদী-বিলের ক্ষতি হলে মানুষ কার কাছে প্রতিকার চাইবে? এ সেতু কবে হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। বর্ষায় যদি পানিপ্রবাহ বেড়ে যায়, তখন ওই সড়কের উজানের জনগণ জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেতে সড়কটি ভেঙে দিতে চাইবে। ভাটির লোকজন যদি ভাঙতে না দেয়, তখন কী হবে? আড়াআড়ি সড়ক থাকলে পরবর্তী সময়ে সেখানে আর সেতু না-ও হতে পারে। এর চেয়েও বড় বড় নদীতে সেতুবিহীন আড়াআড়ি সড়ক করার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। বরং কাঁচা সড়কটুকু হয়তো একদিন পাকা হবে। এভাবেই মরে যেতে পারে আলাইকুমারী নদীটি।
আলাইকুমারী নদীটি কোথাও কোথাও ‘আলাইকুড়ি’ নামেও পরিচিত। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকাভুক্ত এ নদীকে খাল নাম দিয়ে বিএডিসি অর্ধেক অংশ খনন করেছে।
কোথাও কোথাও নদীর মাটি কেটে নদীর ভেতরেই ফেলেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বছর তিনেক আগে নদী খননের নামে নদীর সর্বনাশ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এ নদীতে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দখল আছে। নদীর চেয়ে অনেক ছোট সেতু করে বড়দরগাহ নামক স্থানে নদীটিকে সংকুচিত করা হয়েছে। কোথাও কোথাও নতুন রেকর্ডে নদীটির অনেক অংশ অসাধু ব্যক্তিরা তাদের নামে লিখে নিয়েছে। নদীটির গলা টিপে ধরা হয়েছে। জীবন্ত সত্তা আলাইকুমারীকে মেরে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। নদী হত্যাকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করে অপরাধীদের শাস্তির বিধান করা জরুরি।
চলতি বছর বিএমডিএ (বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) আলাইকুমারী খনন করছে। বিএডিসির মতো বিএমডিএ আলাইকুমারীকে খাল বলছে না, নদী বলছে। সিএস এবং বিদ্যমান নদীর প্রস্থ ধরে তারা খনন করছে। তবে খননকৃত মাটি অপসারণ করা গেলে নদীর প্রাকৃতিক রূপসৌন্দর্য বজায় থাকত।
আলাইকুমারী দেখে আসার পরই কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার একজন নদীকর্মী খন্দকার আরিফ এবং হামিদুলের কাছে জানতে পারলাম, সেখানে একজন জনপ্রতিনিধি একটি বিলের ভেতর দিয়ে আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করছে ৪০ দিনের কর্মসূচির শ্রমিকদের দ্বারা। আমাকে দেখার জন্য ডাকলেও তখন আর যেতে পারিনি। গত ঈদের ছুটিতে সেখানে গিয়েছিলাম। সারা দিন ওই বিল দেখলাম। বিলের নাম চতলা। রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের খিতাবখাঁ মৌজার ওপর চতলা বিল অবস্থিত। এর আয়তন ১৫ দশমিক ৭০ একর। বিলটির ভেতর কয়েকজন অসাধু ব্যক্তি পুকুর বানিয়েছে।
ওই ইউপির সদস্য ফখরুল ইসলাম হীরা আড়াআড়ি সড়কটি নির্মাণ করেছেন। খুব সরু ছোট একটি আল ছিল সেখানে। ৪০ দিনের কর্মসূচি দ্বারা সেই ছোট সরু আলটি প্রশস্ত ও উঁচু করা হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার জন্য মাত্র দু–আড়াই ফুট প্রস্থের একটি পাইপ দেওয়া আছে। অনেকে মনে করছেন, ইউপির সদস্য নিজের জমিতে যাওয়ার জন্য বিলের ওপর আড়াআড়ি সড়ক দিয়েছেন। উঁচু এই পাড় দেওয়ার কারণে তাঁর জমিতে এখন মাছ চাষেরও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। স্থানীয় ভূমি জরিপকারী জালাল উদ্দিন জানান, বিলের পানি বের হতে না পারার কারণে তাঁর জমিসহ অনেকের জমিতে গত বছর জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল। পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় উজানের কয়েক শ একর জমি জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। চতলা বিলের সঙ্গে লাগোয়া কুড়া নামে পরিচিত আরেকটি নিম্নাঞ্চল আছে। সেটিও বিল শ্রেণিভুক্ত। চতলার পানি গিয়ে পড়ে ওই কুড়ায়। ওই কুড়ার পানি ঘড়িয়ালডাঙা বিলে চলে যায়। ঘড়িয়ালডাঙার পানির একটি সরু পথ দিয়ে চাকিরপশা নদীতে মিলিত হয়েছে।
ইউপির সদস্য ফখরুল ইসলাম হীরা জানান, তিনি আড়াআড়িভাবে সড়ক নির্মাণ করেছেন। এখন একটি ছোট সেতু স্থাপন করবেন। কবে করবেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমরা ছোট মানুষ। আমরা কি আর বলতে পারব? পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রস্তাব দেওয়া হইচে। উপজেলা প্রশাসন জানে কখন হবে।’
ঘড়িয়ালডাঙা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ কর্মকার চেয়ারম্যান থাকাকালে ২০১৭ সালে বিলের ভেতরের সব পুকুরের পাড় ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ৪০ দিনের কর্মসূচির সব শ্রমিক ও স্থানীয় আগ্রহী ব্যক্তিদের ডেকে এনেছিলেন পাড়গুলো ভেঙে দেওয়ার জন্য। স্থানীয় মানুষের ধারণা, উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের বাধার কারণে সেই মহতী কাজ করা সম্ভব হয়নি। যদি রবীন্দ্রনাথ কর্মকার এ কাজ করতে পারতেন, তাহলে মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ কর্মকার মাছের পোনা ছেড়ে দিয়ে চতলা বিল মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। চতলা বিলকে মুক্ত ঘোষণা করে একটি সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। সেটি অসাধু ব্যক্তিরা সরিয়ে নেওয়ার কারণে একটি মামলা হয়েছিল। মামলায় কয়েকজনের জেল হয়। রবীন্দ্রনাথ কর্মকার জানান, তিনি চেয়ারম্যান পদে না থাকলেও বিলটি রক্ষা করবেন।
সেতু হওয়ার আগেই বিলের ওপর আড়াআড়ি সড়ক হলো। ভবিষ্যতে যদি সেতু আর না হয়, তাহলে সেই বিলের পানি বের হতে পারবে না। এভাবে বিল এবং ভাটিতে থাকা নদী—উভয়েরই ক্ষতি হবে। এসব ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত তদারকির ব্যবস্থা থাকলে যেখানে ইচ্ছা সেখানে কেউ সড়ক নির্মাণ করতে পারত না। স্থানীয় প্রশাসন ও নাগরিক—কেউই যেন চোখে দেখছে না। এর ক্ষতিকর প্রভাব বহন করতে হবে চোখ থাকা অন্ধদের। বেশি করে বহন করতে হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে। ফলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নদী-বিলের ক্ষতি করলেও সাধারণ মানুষেরই প্রতিবাদ করতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক। ই–মেইল: [email protected]