গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল ভোট গ্রহণসহ অন্যান্য দিক। কৃতিত্বের দাবি করতে পারে অনেকের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনও। সরকারি দলের প্রার্থী ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা আজমত উল্লাকে হারিয়ে সিটি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন।
বিজয়ী প্রার্থীর রাজনৈতিক অতীত কিছুই নেই। তিনি কার্যত তাঁর ছেলের পক্ষে নির্বাচন লড়েছেন। ভোটাররা আস্থা রেখেছেন তাঁর ওপরই। সুতরাং, তাঁকে অভিনন্দন জানাই। রাজধানীর অতি সন্নিকটে একটি জনবহুল শিল্প এলাকাকে কেন্দ্র করে গঠিত সিটি করপোরেশনটি নতুন মেয়রের নেতৃত্বে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে, এ প্রত্যাশা করছি।
নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আর এ প্রক্রিয়া টিকে থাকে ও সফল হয় জনগণের সর্বাঙ্গীণ অংশগ্রহণে। অথচ এসব বিষয়ে আমরা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকেও বেদনাদায়ক বক্তব্য শুনতে পাচ্ছি
তবে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে, নির্বাচনটি বর্জন করেছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তা ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিবেচনায় ভোটার উপস্থিতি ছিল বেশ কম। ৫০ শতাংশের কাছাকাছি।
আর নির্বাচনের ঠিক আগের দিন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ঘোষিত মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা ভোট গ্রহণ ও গণনায় ইতিবাচক ছাপ রেখেছে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। গাজীপুর নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় সাফল্য নিয়ে নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। করতেই পারে। তবে সারা দেশে এক দিনে সব প্রধান রাজনৈতিক দল নিয়ে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের মহড়া এটা নয়। সেটার ব্যাপকতা ও বহুমাত্রিকতা এখানে অনুপস্থিত।
প্রশ্ন উঠতে পারে আমাদের নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা একদৃষ্টে সহায়ক হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন পরিচালনা ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সতর্ক হওয়ার জন্য বার্তাটি কাজ করেছে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়।
অবশ্য আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভিন্ন রাষ্ট্রের নাক গলানোর বিপরীতেও মতামত আছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের একটি উপসম্পাদকীয়র শিরোনাম ‘আ ফেয়ার ওয়ার্নিং অ্যাগেনস্ট আ ফাউল কনডাক্ট’ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তবে বিবেচনায় নিতে হবে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা মাঠপর্যায়ের মূল ক্রীড়নকদের জন্য একইভাবে কাজ করবে, এমনটা আশা করা চলে না।
কেননা, ওই পর্যায়ের অনেকেরই প্রয়োজন নেই মার্কিন ভিসার। তবে তাঁদের যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁদের অনেকের সে প্রয়োজন রয়েছে। তাঁরা হয়তো আগের মতো বেপরোয়া হতে দ্বিতীয়বার ভাববেন। তবে নির্বাচনের একটি সমতল ক্ষেত্র তৈরির জন্য কমিশনের যা করণীয়, তার বিকল্প এগুলো নয়।
কমিশনের করণীয় অনেক কিছুই এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়; বরং নজরে আসে তাদের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি। যেমন গাইবান্ধার একটি উপনির্বাচনে সিসিটিভির মাধ্যমে ভোট গ্রহণের নমুনা দেখে কমিশন বাতিল করেছিল সে নির্বাচন। হয়েছে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত। সামনে এসেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়দায়িত্ব। কিন্তু সে অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমনটি আমরা শুনিনি।
গত ১৫ বছর কার্যত একটি দলই সরকারে আছে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আরও দীর্ঘদিন শাসনক্ষমতায় থাকার নজির আমাদের প্রতিবেশী দেশেই রয়েছে। তাঁরা সেভাবে থাকুন।
তবে জনগণের ম্যান্ডেটটা দৃশ্যমান ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনকে এর প্রতিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। আমাদের প্রত্যাশা, নির্বাচন ঈপ্সিত মানের হোক। এর জন্য সরকার ও কমিশন—সবাইকেই কাজ করতে হবে। কমিশন তাদের আরও ক্ষমতায়নের জন্য একটি আইনের খসড়া সরকারের কাছে পাঠিয়েছিল। এটা তেমন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়নি। আমরা চাই কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য সর্বাঙ্গীণভাবে শক্তিশালী করা হোক। পাশাপাশি এটাও চাই, কমিশন সে ক্ষমতা প্রয়োগে দ্বিধাহীন হবে, কিন্তু দেখি বিপরীতটা।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ওপর কমিশনের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ নির্বাচনের পূর্বশর্ত বললে অত্যুক্তি হবে না। নিকট অতীতের সব কটি সফল নির্বাচনে তাই ছিল। অবশ্য সেসব নির্বাচনের সময় দেশে বহাল ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এটা অনস্বীকার্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দিয়েই নির্বাচনযজ্ঞ সমাধা করতে হবে কমিশনকে। প্রায় ৫০ হাজার ভোটকেন্দ্র এবং ৩ লাখ ভোটকক্ষে ১০ লাখের মতো জনবল আবশ্যক হবে ভোটের দিন। তাদের সব ধরনের অশুভ চাপমুক্ত হয়ে নির্বাচন করতে পারার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব কমিশনের।
একটি জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠপর্যায়ে কর্মরত প্রশাসন বা পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি বড় ধরনের রদবদলের ধারাবাহিকতা থেকে আমরা সরে পড়েছি। বর্তমান ব্যবস্থায় সংসদ সদস্যরা বহাল থাকবেন তাঁদের পদে।
এটা বলা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বলয় অপরিবর্তিত থাকার জন্য একশ্রেণির কর্মকর্তা সরকারের কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছেন।
এটা যদি ভেঙে দেওয়া না যায়, তবে পক্ষপাতহীন নির্বাচনের প্রত্যাশা সুদূরপরাহতই থাকবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো বিষয় জাতীয় নির্বাচনে সাফল্যের জন্য পর্যাপ্ত নয়। মনে রাখতে হবে, নির্বাচনটি হবে ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা রদবদলের। সুতরাং, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কিছুটা বেপরোয়াই হতে পারেন। সে খেলার আম্পায়ার নির্বাচন কমিশন। তঁারা যদি যথাযথ কার্যকর না হন, তবে খেলাটি আবারও একতরফা হবে।
এমনিতে প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচনের মাঠে আনার জন্য কোনো প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। বলা হবে নির্বাচনে কাউকে ডেকে আনা সরকার কিংবা কমিশনের কাজ নয়। আইনের স্থূল ব্যাখ্যায় এটা হয়তোবা ঠিক। তবে নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আর এ প্রক্রিয়া টিকে থাকে ও সফল হয় জনগণের সর্বাঙ্গীণ অংশগ্রহণে।
অথচ এসব বিষয়ে আমরা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকেও বেদনাদায়ক বক্তব্য শুনতে পাচ্ছি। সরকারের একজন মন্ত্রী বলেছেন, গ্রামের জনগণ উন্নয়ন চায়, তারা গণতন্ত্র বোঝে না। বিপরীতে আছে বিরোধী দলের মাঠের আন্দোলন। যুক্ত হচ্ছে বিদেশি স্যাংশন ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা।
তবে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ খোঁজার প্রচেষ্টা লক্ষণীয় নয়। তাই বলতে হয়, গাজীপুর কিংবা সে ধরনের দু-চারটি প্রধান দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন নিয়ে কমিশনের আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। তাদের মাথায় অনেক বড় বোঝা।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব