ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় বহু বিশ্বনেতাকে হতাশ করেছে। ইউরোপের নেতারা উদ্বিগ্ন। কারণ, ট্রাম্প তাঁদের বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা ব্যয় পর্যন্ত বিভিন্ন ইস্যুতে চাপে ফেলবেন। লাতিন আমেরিকার নেতাদের আশঙ্কা, অভিবাসন ইস্যুতে ট্রাম্প তাঁদের শায়েস্তা করবেন। তবে মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
ট্রাম্প ফেরায় এ অঞ্চলের কিছু নেতা হতাশ। আবার কিছু নেতা খুশি। তবে যাঁরা এখন ট্রাম্পের জয়ে খুশি হচ্ছেন, তাঁরা হয়তো ট্রাম্প ক্ষমতা নেওয়ার পর তাঁর কাছে আরও ধীরস্থির ও কম খামখেয়ালি আচরণ আশা করতে শুরু করবেন।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মতো স্বৈরাচারী শাসকেরা। ট্রাম্প এই দুজনেরই প্রশংসা করেছেন। সিসিকে তিনি তাঁর ‘প্রিয় স্বৈরশাসক’ এবং নিজেকে এরদোয়ানের ‘বড় ভক্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন।
আগের মার্কিন প্রশাসনগুলোর মতো ট্রাম্প প্রশাসন মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের লঙ্ঘন নিয়ে সিসি ও এরদোয়ানের ওপর সম্ভবত চাপ দেবেন না। স্বৈরাচারদের কাজকর্মে অযাচিত হস্তক্ষেপ না করার যে নীতি ট্রাম্প অনুসরণ করবেন, তা তাঁদের খুশি করবে।
মিসরের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত আছে এবং তুরস্কের সঙ্গে সামান্য ঘাটতি আছে। ফলে দেশ দুটি জার্মানি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্যসংক্রান্ত ক্ষোভের মুখে পড়বে না। পারস্য উপসাগরের শেখরাও ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া থেকে উপকৃত হবে। আল–সিসি ও এরদোয়ানের ইরান নীতির বিপরীতে অবস্থান করছেন বাহরাইন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতারা। এই নেতারা ইরানের প্রভাবকে দুর্বল করার জন্য শক্তিশালী মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অপেক্ষায় রয়েছেন।
ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও ইরানের বিরুদ্ধে ‘সর্বোচ্চ চাপ’ পুনরুজ্জীবিত হলে বিশেষ করে বাহরাইনের সুন্নি রাজতন্ত্র খুশি হবে। কারণ, ইরান কোণঠাসা হলে তারা বাহরাইনের শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে উসকানি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হবে। পারস্য উপসাগরের দেশগুলোও ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া থেকে উপকৃত হবে। বিশেষ করে বাহরাইন, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতারা ইরানের প্রভাব কমানোর জন্য শক্তিশালী মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি চান।
এই অঞ্চল ইতিমধ্যে অনেক যুদ্ধ, বিপ্লব এবং জিহাদি বিদ্রোহ সহ্য করেছে। তাই তারা হোয়াইট হাউসে একজন শক্তিশালী এবং কঠোর নেতাকেও সহ্য করে টিকে থাকতে পারবে বলে মনে হয়। তবে ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে আমেরিকার মিত্র ও শত্রুরা সমানভাবে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। সময়ই তা বলবে।
এ ছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলো ট্রাম্পের আদান-প্রদানমূলক মেজাজ এবং বড় বড় জমকালো প্রদর্শনীর জৌলুশপূর্ণ দেখনদারির প্রতি ট্রাম্পের আগ্রহের সুযোগ নিতে পারে। এর অংশ হিসেবে তারা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে এমন সব বড় অঙ্কের অস্ত্র চুক্তি করার ঘোষণা দিতে পারে, যদিও সেসব বাস্তবায়নের কোনো ইচ্ছা তাঁদের না–ও থাকতে পারে।
এর বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য মার্কিন মিত্রদের সমস্যার মুখে পড়তে হবে। হামাস ও অন্য ইসলামি গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়ার জন্য রিপাবলিকানরা কাতারকে আক্রমণ করবে। এ ছাড়া লেবাননে বোমাবর্ষণ বন্ধ করার জন্য আমেরিকানরা জেরুজালেম ও বৈরুতের মধ্যে আর দূতিয়ালি করে যাওয়া-আসা করবে না।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় সিরিয়ার কুর্দি গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তুরস্কের কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সিরিয়ান শাখা হিসেবে কাজ করা এই গোষ্ঠী ১৯৮৪ সাল থেকে তুরস্কের সরকারের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে আসছে।
সম্প্রতি তারা আঙ্কারায় একটি মহাকাশ সংস্থায় হামলা চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করেছে। যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান সেনা মোতায়েনে ট্রাম্পের অনীহা আছে, যেহেতু ট্রাম্প এরদোয়ানকে পছন্দ করেন, সেহেতু তিনি সিরিয়ায় থাকা প্রায় ৯০০ মার্কিন সেনাকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই মার্কিন সেনাদের মূলত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পুনরুত্থান ঠেকাতে সেখানে মোতায়েন রাখা হলেও তারা সিরিয়ার কুর্দি দল পিওয়াইডিকে তুরস্কের আক্রমণ থেকে বাঁচতেও সাহায্য করে।
এখন যদি পিওয়াইডি যুদ্ধের মাঠে মার্কিন সমর্থন হারায় এবং তুরস্কের দিক থেকে আক্রমণ আসার আশঙ্কা করে, তাহলে তারা রাশিয়া বা সিরিয়াকে আবার সীমান্তে সেনা মোতায়েন করতে বলতে পারে। এ কারণে, ট্রাম্পের প্রশাসন সিরিয়ার জন্য পরোক্ষভাবে লাভজনক হতে পারে। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফিরে আসাটা আমেরিকার শত্রু ইরান এবং ইরানের সহযোগী সংগঠন হামাস ও হিজবুল্লাহর জন্য সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হওয়ার কথা।
এর কারণ হলো, ট্রাম্প এই দফায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে যা ইচ্ছা তাই করার স্বাধীনতা দিতে পারেন। বেনিয়ামিনের সামনে বাইডেন অল্প যা কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছেন, ট্রাম্প সেগুলো তুলে নিতে পারেন।
ইরান ট্রাম্পকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছে বলে সম্প্রতি যেসব খবর বেরিয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই ট্রাম্পকে খেপিয়ে তুলবে। ইরানের তেল ও পরমাণু স্থাপনার ওপর ইসরায়েল হামলা চালালে সে হামলার বিষয়ে ট্রাম্পের আপত্তি তোলার সম্ভাবনা কম। এ ছাড়া গাজায় বেসামরিক মানুষের হতাহত হওয়া বা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতির ওপর সহিংসতা নিয়েও তিনি দুঃখ প্রকাশ করবেন বলে মনে হয় না।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে নেতানিয়াহু শুধু চাইতেন, ট্রাম্প যেন ইসরায়েলকে তার মতো কাজ করতে দেন এবং পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের সমালোচনা না করেন। কিন্তু এই দফায় তিনি ইসরায়েলের নীতিগুলো বাস্তবায়নে আমেরিকার জোরালো সমর্থন চান।
নেতানিয়াহুর আচরণ এবং তিনি কী করতে যাচ্ছেন, সে বিষয়ে ট্রাম্পের সম্যক ধারণা আছে। ২০২০ সালে হোয়াইট হাউসের এক অনুষ্ঠানে যখন নেতানিয়াহু বসতি সম্প্রসারণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তখন ট্রাম্প বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি সে সময় নেতানিয়াহুকে সমর্থন দেননি। এমনকি তিনি সে সময় নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে সমর্থন দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। তবে এবার ট্রাম্প সে অবস্থান থেকে সরে আসবেন বলে মনে হচ্ছে।
ট্রাম্পের ফিরে আসাটা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তন আনবে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতিতে বড় অদলবদল আসবে।
এই অঞ্চল ইতিমধ্যে অনেক যুদ্ধ, বিপ্লব এবং জিহাদি বিদ্রোহ সহ্য করেছে। তাই তারা হোয়াইট হাউসে একজন শক্তিশালী এবং কঠোর নেতাকেও সহ্য করে টিকে থাকতে পারবে বলে মনে হয়। তবে ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে আমেরিকার মিত্র ও শত্রুরা সমানভাবে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। সময়ই তা বলবে।
● বারাক বারফি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নিউ আমেরিকার একজন সাবেক রিসার্চ ফেলো
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ