‘আমার ছেলে অটিজমে আক্রান্ত বলে আমাকে পরিবারের অন্য কোনো নবজাতককে স্পর্শ করতে দেওয়া হতো না। সন্তানের অটিজমের কারণ হিসেবে সবাই আমাকেই দায়ী করত’, বললেন একজন মা।
তেমন আরেকজন মায়ের কাছে শুনেছি, এক আত্মীয় তাঁকে নিষেধ করেছিলেন সন্তানকে নিয়ে তিনি যেন তাঁর মেয়ের বিয়েতে না আসেন, এতে নাকি সেই আত্মীয়কে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে।
অন্য সবার মতোই অটিজমে আক্রান্ত মানুষদেরও শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং বিনোদনের অধিকার আছে। কিন্তু বাংলাদেশে তারা এবং তাদের পরিবার নানা বৈষম্যের শিকার হয়। অনেকে একঘরে হয়ে যাচ্ছে। অটিজমসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধিতার শিকার অনেককে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়, যেন প্রতিবন্ধী হওয়া তাদের অপরাধ। কিন্তু সীমাবদ্ধতা কি আমাদের নয়? আমরা সমাজটাকে সবার বাসযোগ্য করে তুলতে পারিনি।
অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার হলো শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা, যেখানে শিশুদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ ও আচরণের ক্ষেত্রে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়।
শিশুর জন্মের প্রথম তিন বছরে অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পায়। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর বিকাশ তিনটি ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়—সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা (অন্য কারও প্রতি আগ্রহ না থাকা), যোগাযোগ স্থাপনে বাধা (কথা বলতে না শেখা, কিছু কথা বলতে পারলেও অন্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে না পারা), আচরণের ভিন্নতা (পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ—একই কাজ বারবার করা, একই খেলা বারবার খেলা)।
অটিজমে আক্রান্ত কেউ কেউ স্বাধীনভাবে চলাফেরা কিংবা জীবনধারণ করতে পারে, আবার কারও হয়তো বড় ধরনের প্রতিবন্ধিতা আছে। যার ফলে তাদের সারা জীবন যত্ন ও সহযোগিতা প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশে কোনো পরিবারে অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে দুর্ভাগ্য হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন এবং ভালো থাকা নিশ্চিত করা সম্ভব। এ জন্য দরকার সেবার পরিমাণ ও গুণগত মান বাড়ানো।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিচর্যার অংশ হিসেবে শিশুর বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করতে হবে। এতে কারও অটিজমের লক্ষণ থাকলে তা শুরুতেই ধরা পড়ে।
ফলে প্রাথমিক পর্যায়েই প্রয়োজনীয় মানসিক ও সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হয়। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজের শিশুবিকাশ কেন্দ্রে বয়স অনুযায়ী শিশুদের বিকাশ মনিটরিংয়ের সুযোগ রয়েছে। রোগনির্ণয় এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের স্বার্থে এই ব্যবস্থা তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করা দরকার।
অটিজমে আক্রান্ত মানুষদের শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের চাহিদা, সক্ষমতা এবং শেখার ধরন সম্পর্কে জানতে হয়, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে না। বাংলাদেশে এই শিশুরা বিশেষায়িত বিদ্যালয়ে যায়। এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়াশোনার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
‘আউটস্ট্যান্ডিং দ্য এডুকেশন অব চিলড্রেন উইথ অটিজম ইন বাংলাদেশ: প্যারেন্টস পারস্পেকটিভ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, অটিজমে আক্রান্ত শিক্ষার্থীরা পারিবারিক ও সামাজিক কলঙ্ক, প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতার অভাব, শিক্ষকদের যোগ্যতার ঘাটতিসহ নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
শিক্ষাদান থেকে সুফল পেতে অধিকতর সৃজনশীল উপায়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এ গবেষণাপত্রে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য বিশেষায়িত স্কুলগুলোতে কর্মরত শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার মান নিশ্চিত করার জন্য দরকার নিয়মিত মনিটরিং।
প্রায়ই দেখি, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ-গান করানো হয়। কেউ কেউ ভাবেন, এর মাধ্যমে বুঝি তাদের সমাজের মূলস্রোতে একাত্ম করা হচ্ছে। কিন্তু এ রকম প্রতীকী অংশগ্রহণ তাদের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের মর্যাদার জন্য হানিকর।
প্রতিবন্ধিতা-সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০১৯ প্রণয়ন করা হয়েছে। যেসব শিশুর স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা রয়েছে, তাদের শিক্ষালাভ ও জীবন দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি মূলধারার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করাই এর উদ্দেশ্য।
প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে আরও অনেক শিশু (যাদের অবস্থা তেমন গুরুতর নয়) মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা করতে পারবে। তা ছাড়া অটিজমে আক্রান্ত একজন শিক্ষার্থীকে অন্য কোনো ছাত্র বা ছাত্রীর সঙ্গে জোড়া বেঁধে দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা একজন নির্দিষ্ট সহপাঠীর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পায়, তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারে এ রকম উদ্যোগ বিভিন্ন দেশে ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে।
অটিজমে আক্রান্তরা মানসম্মত শিক্ষা পেলে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। এ ক্ষেত্রে নিয়োগদাতাদের সংবেদনশীলতা প্রয়োজন। কীভাবে তাদের বাড়িতেও যথাযথ সহায়তা করা যায়, সে বিষয়ে মা-বাবা, অভিভাবক এবং পরিচর্যাকারীদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
প্রায়ই দেখি, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ-গান করানো হয়। কেউ কেউ ভাবেন, এর মাধ্যমে বুঝি তাদের সমাজের মূলস্রোতে একাত্ম করা হচ্ছে। কিন্তু এ রকম প্রতীকী অংশগ্রহণ তাদের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের মর্যাদার জন্য হানিকর।
সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাস্ট ২০১৩ সাল থেকে অটিজমসহ স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা নিয়ে কাজ করছে। এই ট্রাস্টের প্রধান উদ্দেশ্য, যেসব ব্যক্তির স্নায়ুগত বিকাশ পুরোপুরি হয়নি, তাদের জীবনের মান বাড়ানো এবং অধিকার রক্ষা করা। আইনি ও নীতিগত প্রতিশ্রুতি আছে, তবে তা বাস্তবায়নে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
অটিজম নিয়ে অনেক ভুল ধারণা ও কুসংস্কার রয়েছে, যা দূর করার জন্য সমাজের সবার সচেতনতা জরুরি। বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণার অবসানে এবং সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যম জোরালো ভূমিকা পালন করতে পাত্রে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় ভুগবেন না।
কিশোরী জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ বলেছেন, ‘আমার অ্যাসপার্জারস সিনড্রোম আছে। তাই আমি অন্যদের থেকে একটু আলাদা। সঠিক পরিবেশ পেলে ভিন্নতাই বিরাট শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে আপনি অন্যভাবে চিন্তা করতে পারেন।’
কারওর চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া সমাজের বেশির ভাগ মানুষের চেয়ে ভিন্ন হলে তাকে ‘ভুল’ নয়, স্বাভাবিক হিসেবে দেখতে হবে। একটি সমাজ অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় তখনই, যখন সেখানে নানাভাবে চিন্তা করা মানুষের স্থান থাকে, তাদের সম্ভাবনা বিকশিত হতে পারে। আমাদের দায়িত্ব এমন সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে এবং সমাজে অর্থপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী