বিরুদ্ধ পরিবেশে বাইডেন প্রশাসনের অভূতপূর্ব অর্জন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

প্রতিযোগিতা বাজারকে সচল রাখে। কিন্তু প্রতিযোগিতার কারণে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সংকুচিত হয়। তাই অনেক ব্যবসায়ীই প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে। তাঁরা চান লাভ। বিনিয়োগ করা মূলধনের ওপর অস্বাভাবিক লাভ তুলে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।

প্রায় ২৫০ বছর আগে অ্যাডাম স্মিথ বলেছিলেন, একই পণ্যের ব্যবসায়ীরা আমোদ-ফুর্তির জন্য খুব কমই এক জায়গায় বসেন। তবে তাঁদের আড্ডা শেষ হয় জনসাধারণের বিরুদ্ধে কোনো একটি ষড়যন্ত্র করে, নয়তো কীভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো যায়, সেই ফন্দি করে।

মার্কিন সরকার প্রায় ১৩০ বছর ধরে বাজারব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা নিশ্চিতের চেষ্টা করে আসছে। আসলে এই লড়াই বিরতিহীন। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতা এড়াতে কোনো না কোনো উপায় খুঁজে বের করে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ক্রমশ গুটিকয় ব্যবসায়ীর হাতে চলে যাওয়ার অজস্র উদাহরণ আছে।

আরও পড়ুন

বাজারে যখন অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য তৈরি হয়েছে, তখন আমরা করপোরেট খাতের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি, ফুলেফেঁপে ওঠা, প্রতিটি খাতে কিছু প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য বিস্তার এবং নতুন ব্যবসায়ীদের বাজারে ভিড়তে না পারার মতো ঘটনা ঘটতে দেখেছি। কিন্তু মার্কিনরা বলার চেষ্টা করে থাকে যে তাদের অর্থনীতি বিশ্বে সবচেয়ে গতিশীল। নতুন উদ্ভাবনার যে যুগ, তারা এর অগ্রভাগে আছে। কিন্তু পরিসংখ্যান তা বলছে না।

উদ্ভাবনের আদর্শ পরিমাপক হলো টোটাল ফ্যাক্টর প্রোডাক্টিভিটি। এর অর্থ হলো বাড়তি মূলধন বা শ্রমের কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া। কোভিড-১৯ অতিমারির ১৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে টিএফপির প্রবৃদ্ধি ছিল তার আগের ১৫ বছরের প্রবৃদ্ধির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে, যখন বাজারে হাতে গোনা কিছু প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া প্রভাব তৈরি হয়েছে। এতে বৈষম্য বেড়ে যায়।

সৌভাগ্যক্রমে অনিঃশেষ খারাপ খবরের ভিড়ে এ খাতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতির খবরও আছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন প্রতিযোগিতাকে টিকিয়ে রাখা এবং তা আরও বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল। সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়েছে।

স্মিথ ঠিক বলেছিলেন, একচেটিয়া বাজারব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, তা অনন্তকাল চলতে থাকবে। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন এমন কিছু অর্জন করল, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে যায়। ভীষণ প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে এ এক অভূতপূর্ব অর্জন।

উদাহরণস্বরূপ, বাজারে প্রতিযোগিতা জারি রাখতে যে ফেডারেল অ্যান্টিট্রাস্ট অথরিটি আছে, তাদের চাপে ফিগমা ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এডোবিকে আত্তীকৃত করার উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে আসে। বায়োটেক করপোরেশন ইলিউমিনা ও গ্রেইলের সঙ্গে সম্পর্কছেদের ব্যাপারে সম্মত হয়। কারণ, ইউএন ফেডারেল ট্রেড কমিশন অভিযোগ করেছিল, এই দুই প্রতিষ্ঠান যদি একজোট হয়, তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার নির্ণয় উদ্ভাবনের যে কাজ চলছে, তা বড়সড় ধাক্কা খাবে।

এতে ক্যানসার পরীক্ষার খরচ বাড়বে, ভুক্তভোগীদের হাতে পরীক্ষা–নিরীক্ষার একাধিক বিকল্প থাকবে না এবং মানসম্পন্ন পরীক্ষাও নিশ্চিত করা যাবে না। এ বক্তব্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে মার্কিন ফিফথ সার্কিট কোর্ট অব অ্যাপিলস।

আরও তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এফটিসি এবং আইন ও বিচার বিভাগ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা জারি করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিতে বেশ কিছু আইন আছে। এসব আইনের ওপর ভিত্তি করেই এফটিসি এবং আইন ও বিচার বিভাগ ওই নির্দেশনাগুলো চূড়ান্ত করেছে। নতুন নির্দেশনায় বেশি জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিরোধব্যবস্থায়। কারণ, কর্তৃপক্ষ মনে করছে, একটি প্রতিষ্ঠানের অন্যটিকে কিনে নেওয়া বা আত্তীকরণের ফলে একক কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে বাজার চলে যেতে পারে। সমগোত্রীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তো বটেই, ভিন্নতা আছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোও যখন একীভূত হতে চাইছে, তখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বিচার–বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আমরা সবাই জানি, সীমাবদ্ধ প্রতিযোগিতা (পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন খাতে এই বাস্তবতা রয়েছে) আছে যেসব খাতে, সেখানে একটি প্রতিষ্ঠানের অন্যটির সঙ্গে একীভূত হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ে। ‘শিকাগো ইকোনমিস্ট’রা বলতে চান, বাজার সাধারণভাবেই প্রতিযোগিতাপ্রবণ। তাই অ্যান্টিট্রাস্ট কর্তৃপক্ষের উচিত সমগোত্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেন একীভূত না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া।

ভিন্নধর্মীগুলোর ক্ষেত্রে মনোযোগী না হলেও চলে। তবে ইলিউমিনা ও গ্রেইলের ব্যাপারে বিচারকেরা যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে তাঁরা এখন ভিন্নধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর একীভূত হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব নিয়েও ভাবছেন।

আমরা সবাই একচেটিয়া বাজারব্যবস্থায় ক্ষতির শিকার হই। কারণ, এ আধিপত্য বাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেয় না। ফলে মোটের ওপর উৎপাদন হ্রাস পায় এবং জীবনযাপনের মান নিচে নেমে যায়। স্মিথ ঠিক বলেছিলেন, একচেটিয়া বাজারব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, তা অনন্তকাল চলতে থাকবে। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন এমন কিছু অর্জন করল, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে যায়। ভীষণ প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে এ এক অভূতপূর্ব অর্জন।

● জোসেফ ই স্টিগলিৎজ নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট