সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের এই হাসি কাদের উদ্দেশে

আল–জাজিরার অনুসন্ধানী ভিডিও প্রতিবেদন ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’

সিনেমায় নায়ক থেকে খলনায়কের ছাপিয়ে যাওয়ার বড় একটি উদাহরণ হতে পারে সত্তর দশকের বলিউডের বিখ্যাত সিনেমা শোলে। আমজাদ খান সেই খলনায়ক গাব্বার সিংয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। গাব্বার সিং বলতেই আমাদের মাথার ভেতরে ঢুকে যায় গগনবিদারি একটি হাসি। বলিউডের অন্যতম ‘এভিল’ বা শয়তানি হাসি বলা হয় এটিকে।

বলিউডের কোনো খলনায়কের হাসিই এখন পর্যন্ত গাব্বার সিংয়ের হাসিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি বলা যায়। তবে কাছাকাছি হিসেবে বলা যায় নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর একটি হাসিকে। কিক সিনেমায় মির্জা গালিবের শের বলে শয়তানি হাসি দিতে দিতে খুন করে ফেলেন একজনকে তিনি। গালিবের সেই শেরটি বাংলা অর্থ দাঁড়ায় এমন: কোনো আশাই পূর্ণ হলো না/ সেই পূর্ণ হওয়ার কোনো পথই দেখি না/ মৃত্যু হবে একদিন নিশ্চিত/ ঘুম সারা রাত আসে না কেন?

আমাদের নাটক কিংবা ঢালিউডের সিনেমার পর্দায় হুমায়ুন ফরীদির শয়তানি হাসি অনন্যই বলা যায়। সংশপ্তক নাটকের কানকাটা রমজান থেকে শুরু করে মহাতাণ্ডব, ঘাতক কিংবা বিদ্রোহী চারিদিকে সিনেমার খলনায়ক চরিত্র—তার হাসি ছাড়া অসম্পূর্ণ। আজকের হিটলার সিনেমায় হিটলারের হাসিই যেন হাসেন তিনি। কুটিল হাসির জন্য আরেকজনের কথা না বললেই নয়—এ টি এম শামসুজ্জামান। দুজনের হাসি একসঙ্গে পাওয়া যায় ভন্ড সিনেমায়। নায়ক–নায়িকার চেয়েও এ সিনেমার খলনায়ক জুটিকেই আমরা মনে রাখি এখনো।

আল–জাজিরার অনুসন্ধানী ভিডিও প্রতিবেদন দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস–এর শেষ দৃশ্য দেখার পর সিনেমার পর্দার খলনায়কের এমন অনেক হাসির কথাই নিশ্চয় অনেকের মনে আসবে। সেই দৃশ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর (জাভেদ) হাসি শোনার পর যে কারও মনে হতে পারে সিনেমার কোনো জাঁদরেল খলনায়কের হাসিই সেটি।

সিনেমার দৃশ্যে আমরা হাসি শুধু শুনি না, দেখিও। খলনায়ক তাঁর দেহ ও মুখের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে অভিনয়সমেত যে হাসি হাসেন, সেটি তো দেখার বিষয়বস্তুও। কিন্তু জাভেদকে পর্দায় দেখা যায় না ঠিকই, তাঁর হাসি শুনেই অনুমান করা যায় তাঁর অঙ্গভঙ্গি কেমন। অভিনয় না করেই যে হাসি, তা তো পর্দার খলনায়ককে ছাড়িয়ে যাওয়ারই কথা। জাভেদের ক্ষেত্রে সেটিই হয়েছে বলা যায়।

‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’-এ সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি, ব্যাংক লোপাট, অর্থ পাচারের মাত্রা এতটাই ছাড়িয়ে গিয়েছিল যে তা নিয়ে এখন প্রথম সারির আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয়। গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা বাস্তবচিত্র ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’কে শুধু একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বললে ভুল হবে, এটি যেন থ্রিলার সিনেমাকেও হার মানায়। যেখানে নায়ক থাকেন পেছনে আর পর্দায় সর্বত্র বিরাজমান খলনায়ক। কিন্তু কেউ এখানে অভিনেতা নন, সবই বাস্তব চরিত্র।

সাইফুজ্জামানের অর্থ পাচার ও বিদেশে অঢেল সম্পদের বিষয়ে নির্বাচনের আগেই আমরা জেনেছি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বরাতে। সেটিরই অকাট্য ও বিস্তারিত প্রমাণ হাজির করে আল–জাজিরার এই প্রতিবেদন।

যেখানে বলা হয়, সাইফুজ্জামান লন্ডন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাইতে ৬০০টির বেশি স্থাপনার মালিক। শুধু লন্ডনেই আছে তাঁর ৩৬০টি বাড়ি। এর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষস্থানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা। বাড়িগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য ৩২ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। শুধু বাড়ি বা স্থাপনার বিবরণ নয়, তাঁর বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য গাড়ি, স্যুট, ঘড়ি বা জুতার পেছনে যা খরচ, তা শুনলে পিলে চমকে ওঠার মতোই।

গণ–অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যেভাবে সর্বত্র আলোচনা চলছে, রাজনীতিতে সংস্কার নিয়ে খুব একটা নয়। সংস্কার তো রাজনীতিতেই বেশি দরকার, কারণ রাজনীতিবিদেরাই দিনশেষে এ রাষ্ট্রটা চালান। রাজনীতি ও পলিটিক্স—দুই ভাষায় একই শব্দ হলেও এ দেশের মানুষের কাছে এর ভিন্ন অর্থ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেটিকে এক করতে দেন না এই সব ‘খলনায়ক’।

গত এক যুগে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী থাকাকালে এসব সম্পদ তিনি গড়েছেন এবং তা বিদেশে পাচার করা অর্থেই। কারণ, বাংলাদেশের কোনো আইনেই এত অর্থ বৈধভাবে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এভাবেই বাংলাদেশের গরিব, খেটে খাওয়া, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের কষ্টের টাকা কীভাবে দিনের পর দিন লোপাট করে বাইরে পাচার করা হয়েছে। তিনি শুধু একজন নন, আছেন আরও অনেকে। প্রজার সম্পদ চুষে নেওয়া আদি যুগের বিশাল কোনো সাম্রাজ্যের একেকজন অধিপতি যেন সবাই।

এত লুটপাট বা অর্থ পাচারের পরও তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। আল–জাজিরার প্রতিবেদনটি দেখতে দেখতে তীব্র জিজ্ঞাসা তৈরি হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী কি তাহলে অবশেষে ধরা পড়লেন? কিন্তু নাহ, সাংবাদিককে ফোনের ওপাশ থেকে ‘খ্যাঁ খ্যাঁ খ্যাঁ ’ করে হাসতে হাসতেই জানালেন, তিনি নিরাপদে বেরিয়ে গেছেন। দর্শক মাত্রই স্বীকার করবেন, এ হাসি নিছক কোনো সাধারণ হাসি ছিল না। এটি শুধু নিরাপদে দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আত্মতৃপ্তিরও হাসি নয়।

প্রশ্নকর্তা যখন জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কই এখন? আপনি কি বাংলাদেশে, বের হতে পারেন নাই?’ তার উত্তরে সেই হাসির অর্থ—‘আপনি কি জানেন না, আমি কোথায় থাকতে পারি, আপনি কীভাবে ভাবলেন যে আমি বের হতে পারব না।’ এই হাসি ‘টাকার শক্তি’ নিয়ে সেই চিরায়ত বাক্যকেও সামনে আনে—যার টাকা আছে, তাকে পৃথিবীতে কেউ আটকাতে পারে না। তাকে আটকানোর সাধ্য কার? আসলেই, এত এত লুটপাটকারীর নাম আমাদের মুখে মুখে দু–একজন ছাড়া তো তাঁদের কাউকেই তো ধরা গেল না।

এই হাসি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাচ্ছিল্য ও উপহাসের তীব্র বহিঃপ্রকাশও। নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার এক ফেসবুক পোস্টে যথার্থই বলেছেন, ‘এই “খ্যাঁ খ্যাঁ খ্যাঁ” হাসি জাভেদের একার নয়। এই হাসি যাঁরা গত ১৭ বছর দেশটাকে ফোকলা বানিয়েছে, তাদের সবার। এই হাসি ওই সব অফিসারের, যাঁরা শত শত মানুষকে গুম করেছে, খুন করেছে। যারা বাবা হারিয়েছে, যারা সন্তান হারিয়েছে, এই খ্যাকখ্যাকে হাসি তাদের কানে বর্শার ফলার মতো বিঁধছে।’

এক সহকর্মী এই হাসির আরেক অর্থ জানালেন। এটি হচ্ছে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের দেশে থেকে যাওয়া নেতা–কর্মীদের প্রতি পালিয়ে যাওয়াদের বিদ্রূপ বা ঠাট্টা–মশকরাপূর্ণ হাসিও। দলের প্রতি আনুগত্যের নামে ক্ষমতা চর্চার মাধ্যমে পরোক্ষ–প্রত্যক্ষভাবে মানুষের ওপর জুলুম চালিয়ে গিয়েছিলেন যাঁরা, দেশের ভেতরে তাঁরা এখন নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন।

শুধু তাঁরা নন, যাঁরা কিছু না করেও সুবিধাভোগী ছিলেন বা একান্তই আদর্শের কারণে দলকে ভালোবেসে গিয়েছেন, ছিলেন দলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এবং দলের এমন অধঃপতনে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেয়েছেন—তাঁরাও সামাজিকভাবে কোণঠাসা হয়ে গেছেন। তাঁদের সবার প্রতিই জাভেদের এই উপহাসের হাসি। যেন তিনি তাঁদের বলছেন—‘এটিই হলো পলিটিকস!’

আওয়ামী লীগের বড় কর্মী ও সমর্থক গোষ্ঠী আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। কিন্তু তাদের ‘বিপদে’ ফলে পালিয়ে যাওয়া সাইফুজ্জামান চৌধুরীরা যেন নওয়াজুদ্দিনের মতোই বলেন—তোমাদের কোনো আশা পূর্ণ হবে না, পূর্ণ হওয়ার পথও নেই। আছে শুধু নির্ঘুম রাতের যন্ত্রণা।

যাহোক, জাভেদের এই ‘খ্যাঁ খ্যাঁ খ্যাঁ’ হাসি বিভিন্ন অর্থে গোটা জাতিকে অনেক দিন তাড়িয়ে বেড়াবে, তাতে সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে এ হাসি শেখ হাসিনা সরকারের একটি সিম্বল বা প্রতীক হয়েও থাকবে।

কথা হচ্ছে, গণ–অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যেভাবে সর্বত্র আলোচনা চলছে, রাজনীতিতে সংস্কার নিয়ে খুব একটা নয়। সংস্কার তো রাজনীতিতেই বেশি দরকার, কারণ রাজনীতিবিদেরাই দিনশেষে এ রাষ্ট্রটা চালান। রাজনীতি ও পলিটিক্স—দুই ভাষায় একই শব্দ হলেও এ দেশের মানুষের কাছে এর ভিন্ন অর্থ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেটিকে এক করতে দেন না এই সব ‘খলনায়ক’।

রাজনীতিতে সংস্কার না আনলে এমন ‘খলনায়ক’ সামনেও দেখতে হবে, তা তে কোনো সন্দেহ নেই। তখন হয়তো আমাদের আবারও আফসোস করতে হবে এই বলে—আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম!

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

ই–মেইল: [email protected]