গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম আলোয় ‘তরুণেরা কি সব দেশ ছেড়ে চলে যাবেন’ শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটি পাঠকদের মধ্যে, বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলে। প্রথম আলোর ফেসবুক পেজের অসংখ্য মন্তব্য থেকে বেশ কিছু মন্তব্য পড়ার সুযোগ হয়েছিল আমার।
মন্তব্যকারীদের অধিকাংশই ছিলেন বয়সে তরুণ। অবাক করা বিষয় হলো, প্রায় প্রতিটি মন্তব্যই ছিল হতাশায় ভরা। মন্তব্যগুলোয় দেশের বাইরে তরুণদের ভবিষ্যৎ গড়ার পক্ষের যুক্তিগুলো আরও স্পষ্ট হয়েছে আমার কাছে। মনে হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এ দেশে বসবাসকারী তরুণদের হতাশার পরিমাণ আমার ধারণার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।
আমার লেখায় আমি যে তথ্য-উপাত্তগুলো ব্যবহার করেছিলাম, তার অধিকাংশই ছিল বেশ পুরোনো; কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ের। সম্প্রতি তরুণদের নিয়ে প্রকাশিত দুটি জরিপ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটি হলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২’ এবং অন্যটি হলো এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘যুব জরিপ-২০২৩’।
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী যেখানে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১ শতাংশের কিছু বেশি, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় বা সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে বেকারত্বের হার ১২ শতাংশ। বর্তমানে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পাস বেকারের সংখ্যা মোট ৮ লাখ। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘যুব জরিপ-২০২৩’-এ উঠে এসেছে তরুণদের অপ্রাপ্তি ও হতাশার কথা।
তরুণেরা সব দেশ ছেড়ে চলে গেলে কাদের জন্য বাস্তবায়িত হবে নীতিমালা? ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতির সুবিধা পেতে চাইলে এই তরুণ প্রজন্মকে আটকাতে হবে এবং তাদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে
এই জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৬ হাজার অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ যুবক সুযোগ পেলে স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। রাজনীতি নিয়ে তরুণদের হতাশা ও অনাগ্রহ নিদারুণভাবে ফুটে উঠেছে। জরিপে মাত্র ১১ শতাংশ তরুণ রাজনীতি নিয়ে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
তরুণদের ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ কখনো জাতীয় নির্বাচনে এবং ৪৬ শতাংশ কখনো স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দেননি। তাঁরা দেশের রাজনীতি-সম্পর্কিত কোনো সভা-সমাবেশ কিংবা আলোচনায় যোগ দেন না, পড়েন না রাজনীতির ওপর লেখা কোনো বই কিংবা সংবাদপত্র। রাজনীতিবিষয়ক খবরের জন্য তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করেন।
নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘যুব জরিপ-২০২৩’-এ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে তরুণদের দুশ্চিন্তার বিষয়টি আশঙ্কাজনক। মতামত প্রকাশ নিয়ে দ্বিধা, সংকোচ ও অস্বস্তিতে থাকেন বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ তরুণ এবং মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এমনকি ১২ শতাংশ তরুণ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশবিরোধী বিভিন্ন আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাতিলেরও দাবি জানিয়েছেন।
এই জরিপগুলোর তথ্য একত্র করলে যা পাওয়া যায়, তা হলো তরুণেরা ভালো নেই এই দেশে। জরিপে উঠে আসা প্রায় প্রতিটি তথ্য হতাশাগ্রস্ত তারুণ্যের এক বাংলাদেশের ইঙ্গিত দেয়। তারুণ্যের হতাশার এই চিত্র কিন্তু নতুন নয়। তরুণদের নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন জরিপ।
আমরা জানি, যেকোনো জরিপের প্রধান উদ্দেশ্য হলো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা; যেন তাঁরা বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন। পরিকল্পনা গ্রহণে রাষ্ট্রের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও নীতিনির্ধারকেরা জরিপের তথ্যে বিচলিত হন কি না জানি না। কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়; অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। তরুণদের হতাশাও কমে না।
বাংলাদেশে ২০১৭ সালে প্রণীত হয়েছে জাতীয় যুবনীতি-২০১৭। বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্পষ্টভাবে শিক্ষিত যুব বেকারত্ব রোধে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তরুণদের ক্রমবর্ধমান হতাশার চিত্র নীতিমালা ও পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে।
তরুণেরা কেবলই আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে থাকেন হতাশার সাগরে। হতাশা থেকে বাঁচতে কেউবা নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন, আবার কেউবা বিমানে চেপে উড়ে যান ইউরোপ কিংবা আমেরিকার কোনো দেশে। আর একবার বেরিয়ে পড়লে তাঁরা আর কখনো দেশে ফিরে আসেন না।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ, সংখ্যায় যা পাঁচ থেকে ছয় কোটি। তরুণেরা সব দেশ ছেড়ে চলে গেলে কাদের জন্য বাস্তবায়িত হবে নীতিমালা? ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতির সুবিধা পেতে চাইলে এই তরুণ প্রজন্মকে আটকাতে হবে এবং তাঁদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
মোড়কে আবদ্ধ আইন কিংবা নীতিমালা আর ড্রয়িংরুমে সাজানো শোপিসের মধ্যে বস্তুতপক্ষে কোনো পার্থক্য থাকে না। তরুণদের বাঁচাতে হলে আপাতত কয়েকটি বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া খুব প্রয়োজন বলে মনে করি। ১. তরুণদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা, ২. যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, ৩. তরুণদের দেশের বাইরে স্থায়ী হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং ৪. তরুণদের আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলা।
তরুণদের স্বপ্ন দেখতে শেখানো খুব জরুরি। স্বপ্নবিহীন তারুণ্য অর্থ দিগ্ভ্রান্ত আগামী।
● নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী