অগ্রহায়ণ এলে আমার মন কেমন করে! কমলা রঙের রোদ দেখতে পাই। মনে হয়, ফিরে গেছি শৈশবে, রংপুরে; মনে হয়, সেই যে খাকি রঙের প্যান্ট, সাদা শার্ট, স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে হাতে বইখাতা নিয়ে বিকালবেলা জিলা স্কুল থেকে হেঁটে হেঁটে ফিরছি বাসায়; পথে পড়ল জুনিয়র ট্রেনিং কলেজ; তার মাঠ, লিচুগাছগুলো পেরিয়ে আরেকটু হেঁটে শ্যামাসুন্দরী খালের দিকে যাচ্ছি; চোরকাটা ভরা সরু হাঁটাপথ, ফনিমণসার ঝোপে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে; শটিবন, ফিরোজা রঙের পাতাওয়ালা একটা কাঁটাগাছের গুল্মে হলুদ রঙের ফুল, আর সাদা সাদা মধুফুলের গাছ, ফড়িং উড়ছে, প্রজাপতিগুলো পাখা বন্ধ করছে খুলছে, একটা বেজি মাথা উঁচু করে তাকিয়ে আছে শটিবনের ধারে, অলস গরু শুয়ে আছে, তার পিঠে দুটো ফিঙে কি কাদাখোচা পাখি; মাঠ জুড়ে শুয়ে আছে রোদ, অনেক কমলা রঙের রোদ; বিশাল গাভির মতো শুয়ে আছে রোদ... শ্যামাসুন্দরীর শুকনো খাল পেরিয়ে যাব; তারপর পিটিআই। সেটার দোতলায় আমাদের বাসা। মোছা মেঝে ঠান্ডা হয়ে আছে। বড়আম্মা চুল ছেড়ে দিয়েছেন, নারকেল তেল মাখছেন। নারকেল তেলের গন্ধ ঘর জোড়া। কদিন পর নারকেল তেলের শিশিতে তেল জমতে শুরু করবে। বারান্দায় রোদে দিতে হবে সেই তেল। ছোটআম্মা নামাজ পড়তে যাবেন বিছানা থেকে উঠে শাড়ি সামলাচ্ছেন। আব্বা রেডিওতে ভাওয়াইয়া গান শুনবেন বলে নব ঘোরাচ্ছেন।
হাঁটু পর্যন্ত ধুলো। আম্মা বলবেন, হাতমুখ ধো। মাদুরে কিংবা পিঁড়িতে বসে পড়লে সামনে আসে গরম দুধ। হয়তো বা খই। লাল গুড় মেখে খেতে খেতে মনে পড়ে, চালের বস্তায় জঙ্গল থেকে পেড়ে আনা আতা রেখেছি। পাকল কি?
সকালবেলা এই মাঠে হলুদ বিবর্ণ ঘাসে শিশিরবিন্দু সত্যি মুক্তোর মতো ঝকঝক করত। আমাদের নিজেদের হাতে গড়ে তোলা বাগানে ছোট ছোট কপির চারা, প্রতিটা চারার পাশে আবার কলাগাছের বাকলের শেড। সেই ছোট ছোট চারার গায়ে সকালে শিশির জমে আছে।
এই শীত শীত সন্ধ্যা, কামিনি ফুলের মাদকতাভলা ঘ্রাণ; আকাশে চাঁদ, কার্তিকের চাঁদ; ভোরবেলা শিউলিতলায় গিয়ে কোছা ভরে ফুল কুড়িয়ে আনা। শিশিরমাখা ফুলে জামা ভিজে সারা।
২.
রবীন্দ্রনাথের ওই গানটা নিয়ে একবার খুব দুর্ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম। কে রয় ভুলে তোমার মোহন রূপে।
তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে।
জানি না কি মরণ নাচে, নাচে গো ওই চরণমূলে॥
শরৎ-আলোর আঁচল টুটে কিসের ঝলক নেচে উঠে,
ঝড় এনেছ এলোচুলে॥
শরতের রূপে কেন রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ না হয়ে তরাসে কেঁপে উঠেছিলেন। পরে এই প্রশ্নের জবাব পেয়েছিলাম গৌতম চৌধুরীর লেখা ‘কে রয় ভুলে তোমার মোহন রূপে’ নামের একটা প্রবন্ধে। ‘১০১ বছর আগে শরৎকালের কিছু আগে হইতেই অবশ্য ইউরোপ জুড়িয়া মরণ নাচিয়া উঠিয়াছিল। জার্মানি ইং ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসের ২ তারিখে রাশিয়া, আর ৩ তারিখে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিল।... শুরু হইয়া গেল ১ম বিশ্বযুদ্ধ। শান্তিনিকেতনের মন্দিরে উপাসনা শেষে রবীন্দ্রনাথ তাহার পরদিন বলিলেন, “সমস্ত ইউরোপ জুড়ে আজ এক মহাযুদ্ধের ঝড় উঠেছে। কত দিন ধরে গোপনে গোপনে এই ঝড়ের আয়োজন চলছিল। কোনো রাজমন্ত্রী কূট-কৌশলজাল বিস্তার করে যে সে আগুন নেভাতে পারবে তা নয়; মার খেতে হবে, মানুষকে মার খেতেই হবে।”’
১৯১৫ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তিনি চিঠিতে লেখেন: ‘আমি deliberately suicide করতেই বসেছিলুম—জীবনে আমার লেশমাত্র তৃপ্তি ছিল না।'
আর বাংলাদেশের শাসক, ভাগ্যনিয়ন্তা, নীতিনির্ধারকদের বলি, বাংলাদেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা, চলাচলের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সমবেত হওয়ার অধিকার, ভোট দিয়ে শাসক বাছাই করার অধিকার প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিন। নাগরিকেরাই রাষ্ট্রের মালিক। রাষ্ট্রযন্ত্রের কলকব্জা যেন নাগরিকদের চেয়ে বড় হয়ে না ওঠে।
এবারের শরত-হেমন্তও কিন্তু এই রকমের হতাশা নিয়ে এসেছে। ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে শিশুদের, নারীদের, বেসামরিক মানুষদের। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই।
প্রথম আলো থেকে জানতে পারলাম, আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অব পলিটিক্যাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক ছিলেন জশ পল। এ বিভাগ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র স্থানান্তরের বিষয়টি দেখভাল করে থাকে। ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের অন্ধ নীতির প্রতিবাদে তিনি চাকরি ছাড়েন। ২৩ অক্টোবর তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে একটি নিবন্ধ লেখেন, যাতে তিনি কেন চাকরি ছেড়েছেন, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, ইসরাইলে পাঠানো আমেরিকার অস্ত্র বেসামরিক মানুষ হত্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে, অথচ আমেরিকা তাঁর নিজের অস্ত্র পাঠানোর নীতি নিজে মানছে না। "অস্ত্রবাণিজ্যের নীতিবাক্যই হচ্ছে—‘প্রথমত, কোনো ক্ষতি নয়।’ অন্তত যতটা সম্ভব কম ক্ষতির ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনে ক্লাস্টার অস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল। ওই বিতর্কের মাধ্যমে আমরা দেখিয়েছিলাম, চরম সংকটের মধ্যেও আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।
যখন ইসরায়েলের বিষয় আসে, তখন বিতর্ক ও আলোচনায় আমাদের অনীহা দেখা যায়। এটি কিন্তু ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রমাণ নয়। বরং ইসরায়েলের প্রতি আমাদের এই নীতি অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে। এমনকি এই নীতি আমাদের মূল্যবোধ থেকে সরে যাওয়ার এবং গাজার লাখ লাখ মানুষের দুর্দশাকে উপেক্ষা করার প্রমাণ দেয়।
এই পররাষ্ট্র দপ্তর সেই পররাষ্ট্র দপ্তর নয়, যাকে আমি চিনি। এ কারণে আমাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে।"
যুক্তরাষ্ট্রের মেইন রাজ্যে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয়েছে ২২। কোনো কোনো আমেরিকান মন খারাপ হলেই অস্ত্র নিয়ে বের হয়, এবং গুলি করে মানুষ মারতে থাকে। আমেরিকাকে বলি, আমেরিকা, তুমি নিজের দেশে মানবাধিকার রক্ষা করো। তারপর অন্যদেশে মানুষ মারার জন্য তোমার যে অস্ত্রচালান তা বন্ধ করো।
আর বাংলাদেশের শাসক, ভাগ্যনিয়ন্তা, নীতিনির্ধারকদের বলি, বাংলাদেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা, চলাচলের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সমবেত হওয়ার অধিকার, ভোট দিয়ে শাসক বাছাই করার অধিকার প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিন। নাগরিকেরাই রাষ্ট্রের মালিক। রাষ্ট্রযন্ত্রের কলকব্জা যেন নাগরিকদের চেয়ে বড় হয়ে না ওঠে।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক