অভ্যুত্থানের সরকার কেন সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না

বাজারে ভারসাম্য রাখতে এবং জিনিসপত্রের দাম নাগালের মধ্যে রাখতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল, শক্ত হাতে সিন্ডিকেট দমন করা, প্রতিযোগিতা কমিশনকে সক্রিয় করা, ঘোষণা দিয়ে সরকারি ক্রয় বাড়ানো এবং স্বল্প মেয়াদেই সরকারের মজুত সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা। এগুলো নতুন বা অজানা কিছু নয়, বহুল আলোচিত সমাধান। এরপর সরকার কেন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না, তা নিয়ে লিখেছেন মাহা মির্জা

দেশে এখন ‘ভাঙাভাঙির’ পক্ষে-বিপক্ষে রাজনীতি চলছে; অথচ যা আসলেও ভেঙে ফেলা দরকার ছিল, সেই মাফিয়া সিন্ডিকেট নিয়ে রাজনীতির মাঠে ন্যূনতম কোনো আলাপও নেই। এই চক্রের আস্ফালনে দেশের সাধারণ মানুষ, কৃষক আর শ্রমিক কী ভীষণ নিদারুণ কষ্টের দিন পার করছেন।

কৃষি উপকরণের দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই, বাজারে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে, এরই মধ্যে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার, দেশি বিস্কুট, ফলমূল, চশমা আর মশার কয়েলের মতো বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর বসানো হয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। নিম্ন আয়ের মানুষ কী করে বাঁচে এই দেশে?

এদিকে হুট করে আলুর হিমাগারের ভাড়া হঠাৎ দ্বিগুণ হয়ে গেল। গত বছর ১০০ বস্তা আলু রাখতে কৃষকের খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এই বছর খরচ পড়ছে ৬০ হাজার টাকা!

এর আগে বীজ আলুর একেকটা বাক্স (৫০ কেজির) বিক্রি হয়েছে ৭-৮ হাজার টাকায়। এই বছর একেক বাক্সের দাম চাওয়া হচ্ছে ২০-২২ হাজার টাকা! অথচ এবার বীজ আলুর পর্যাপ্ত আমদানি হয়েছে। সংকট থাকার কথাই না।

আমরা আরও দেখলাম নতুন বাণিজ্য উপদেষ্টা দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৮ টাকা বেড়ে গেল! সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো, ‘দাম বাড়ানোর এক ঘোষণায় আচমকা বাজার থেকে হারিয়ে যাওয়া লুকানো তেলের বোতল ফিরেছে দোকানে।’ অর্থাৎ সংকট দেখিয়ে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল!

ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনেও একই দশা। গোটা পোলট্রি বাজার দখল করে ফেলেছে চার-পাঁচটি বড় কোম্পানি। ফিড ও মুরগির বাচ্চার ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তাদের। জোটবদ্ধ হয়ে দাম বাড়ায় তারা। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুদ্র খামারিরা প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারেন না।

আরও পড়ুন
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বহু দরিদ্র শ্রমজীবী তরুণের রক্তের বিনিময়ে আমরা নতুন একটি সরকার পেয়েছি। ছয় মাস পার হওয়ার পরও এই সরকার যদি সিন্ডিকেট ভাঙার প্রশ্নে ন্যূনতম ‘পলিটিক্যাল উইল’ বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে না পারে, জনগণের জরুরি খাদ্য কেনাকাটায় এতটুকু স্বস্তি ফেরাতে না পারে, বরং উল্টো বিদেশি সংস্থার ‘প্রেসক্রিপশন’ মেনে অসহায় মানুষের ওপর আরেক দফা উচ্চ ভ্যাট বসায়, তাহলে এত বড় বড় উচ্চাভিলাষী সংস্কারের আলাপ, অথবা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রতিশ্রুতি বড় ফাঁপা শোনায়।

এসব দাম বাড়াবাড়ির সঙ্গে চাহিদা জোগানের কোনো সম্পর্ক নেই, মুক্তবাজার অর্থনীতির সম্পর্ক নেই। সবাই জানে, যোগসাজশ করে দাম বাড়ায় বৃহৎ পুঁজির সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট মানে বড় ব্যবসায়ী, আড়তের মালিক আর শক্তিশালী করপোরেট গ্রুপগুলোর যোগসাজশ।

শেখ হাসিনার আমলে তারা সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভয়ংকর মাফিয়া চক্র হয়ে উঠেছিল। এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থানের পরও বাজারের ওপর তাদের অনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আগের মতোই বহাল আছে। বড় বড় একেকটি গ্রুপ বাজারের ২৫-৩০ ভাগ শেয়ার দখল করে আছে।

চালের সিন্ডিকেট, তেলের সিন্ডিকেট, ডিমের সিন্ডিকেট, চিনির সিন্ডিকেট—কোনো কিছুই ভাঙা যাচ্ছে না। দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। টিসিবির লাইনেও ক্লান্ত মানুষের দীর্ঘ লাইন বাড়ছে।

এই বাজার মাফিয়াদের ভাঙবে কে

দেশে অভাবনীয় একটা গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে; মহাপরাক্রমশালী হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে; জনগণের তুমুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অথচ রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলছেন, সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়। সিন্ডিকেট খুব শক্তিশালী!

শেখ হাসিনা ও তাঁর দুর্নীতিবাজ মন্ত্রিসভা না হয় এস আলম আর বেক্সিমকোর মতো মাফিয়া চক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, তাদের আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক ছিল, ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারা ছিল। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের কিসের দায়? তাদের হাত-পা বাঁধা কেন? কেন ভাঙা যাবে না আড়তমালিকদের সিন্ডিকেট?

হাজার হাজার বোতল সয়াবিন তেল আর শত শত বস্তা আলুর বীজ লুকিয়ে রাখার শাস্তি হবে না কেন? মালিকেরা একজোট হয়ে কোল্ডস্টোরেজের ভাড়া দ্বিগুণ করে দিলে জরিমানা করা যাবে না কেন? রাস্তায় আলু ফেলে প্রতিবাদ করা কৃষকের চোখের পানি বড় বড় চেয়ারগুলো পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না কেন? বাজার মাফিয়াদের প্রতি সরকারের এই নতজানু নীতি কিসের আলামত?

অথর্ব প্রতিযোগিতা কমিশন ও সরকারের দায়

বিশ্বের সব দেশেই প্রতিযোগিতা আইন আছে, প্রতিযোগিতা কমিশনও আছে। বাংলাদেশেও এসব আছে। সচিব-উপসচিব পদমর্যাদার লোকজন এই কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন।

কমিশনের কাজ বাজারে সার্বিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিত করা। বড় ব্যবসায়ী, ওষুধ কোম্পানি, আড়তের মালিক, হিমাগারের মালিক যেন একযোগে সিন্ডিকেট করে জরুরি পণ্যের দাম বা হিমাগারভাড়া বাড়িয়ে দিতে না পারেন, সেই তদারকি করা।

বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইন ও প্রতিযোগিতা কমিশন গঠিত হয় ২০১২ সালে। এই কমিশনের কার্যপ্রণালি পড়লে মনে হয়, কমিশন সিন্ডিকেট ভেঙে খানখান করে দেবে! এত ভালো ভালো কথা, এত পরিণত একাডেমিক বোঝাপড়া!

বলা হয়েছে, এই কমিশন ‘ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ’, ‘মনোপলি’, ‘অলিগোপলি অবস্থা’, ‘জোটবদ্ধতা (কলিউশন)’ অথবা ‘কর্তৃত্বময় অবস্থান’ (ডোমিন্যান্ট পজিশন) সংক্রান্ত প্রতিযোগিতাবিরোধী সব কর্মকাণ্ড ‘প্রতিরোধ’ করবে, ‘নিয়ন্ত্রণ’ করবে, বা ‘নির্মূলকরণ’ করবে। অর্থাৎ বাজার থেকে সিন্ডিকেট একেবারে ‘নির্মূল’ করে ফেলার প্রতিশ্রুতি। এইটুকু করতে পারলে তো বিপ্লবটাই হয়ে যেত!

কিন্তু এই বিশেষ কমিশনটিকে বাস্তবে আদৌ কোনো কাজ করতে দেখি আমরা? চালের দাম, তেলের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানোর পরও জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন পাওয়া এই কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? প্রতি মণ বীজ আলুর দাম এক লাফে দুই হাজার টাকা বাড়ল কী করে? হিমাগারভাড়া এক লাফে দ্বিগুণ হলো কী করে?

চাষিরা ঠিকই জানেন, দাম বাড়ায় কে, ভাড়া বাড়ায় কে। অথচ এই অথর্ব কমিশন কি জানে না? ব্যবস্থা নিয়েছে তারা?

হাসিনার দেশে না হয় মাফিয়া ব্যবসায়ীদের সরাসরি সুরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এখন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা মূলত দুটো। প্রথমত, এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জরুরি এই কমিশন অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের আড্ডা মারার ক্লাবের মতোই অথর্ব। অর্থাৎ অক্ষম ও নতজানু আমলাদের দিয়ে চলছে দেশের সবচেয়ে জরুরি এই কমিশন। কিন্তু জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এ রকম একটি অকেজো কমিশন পালার মানে কী? বরং নতুন করে ঢেলে সাজানো হোক। আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতি সমিতির প্রতিনিধি, একাডেমিশিয়ান, মানবাধিকারকর্মী ও কৃষকদের প্রতিনিধি রাখা হোক কমিশনে।

সবাই জানে, উৎপাদনের একদম শুরু থেকেই প্রতিটা কৃষি উপকরণের দাম বাড়ে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে। কাজেই উৎপাদন পর্যায় থেকেই কমিশনকে তৎপর থাকতে হবে। সিন্ডিকেট ভাঙতে কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তা লাগবে, জনগণের সম্পৃক্ততা লাগবে। শুধু লোকদেখানো ‘কারওয়ান বাজার মনিটরিং’ করলে খাদ্যপণ্যের দাম কমে না।  

দ্বিতীয়ত, এই কমিশনের তদন্ত করার এখতিয়ার আছে, মামলা করার এখতিয়ার আছে কিন্তু বিচারিক ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ তদন্ত সম্পন্ন করে মামলা করতে হলে কমিশনকে প্রচলিত আদালত ব্যবস্থার কাছেই যেতে হবে। তার মানে হলো, এক মৌসুমে কারসাজি করে বীজের দাম বাড়াবে সিন্ডিকেট, আর পরের মৌসুমে গিয়ে ‘ফাইন’ করবেন বিজ্ঞ আদালত? তত দিনে সব হারানো কৃষক ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে গ্রামছাড়া?

সমাধান একটাই। প্রতিযোগিতা কমিশনকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে হবে। ভারত ও পাকিস্তানের কম্পিটিশন কমিশনের বিচারিক ক্ষমতা আছে। বাংলাদেশের সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল বসানোর এখতিয়ার আছে, দ্রুত বিচার করে রায় দেওয়ার ক্ষমতা আছে, অ্যাপিলেট ডিভিশনও আছে। ভারতের প্রতিযোগিতা কমিশনের তো বড় কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট দমন করারও নজির আছে।

সম্প্রতি ভারতের চারটি বড় ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়ে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেটের মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ আনে ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান এফসিআই (ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়া)। ভারতীয় প্রতিযোগিতা কমিশন তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেলে একেকটি ওষুধ কোম্পানিকে আলাদা করে প্রায় শত কোটি রুপি জরিমানা করে।

২০২২ সালে ভারতের ডিম উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীদের সংগঠন এনইসিসির (ন্যাশনাল এগ কো–অর্ডিনেশন কমিটি) বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে প্রাইজ ফিক্সিংয়ের (যোগসাজশ করে দাম বাড়ানো)। কমিশন তদন্ত করে এনসিসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

এদিকে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা কমিশন তো বিএমডব্লিউ আর ভক্সওয়াগনের মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকেও মিলিয়ন ডলার জরিমানা করতে পারে জনস্বার্থবিরোধী যোগসাজশের জন্য।

অর্থাৎ দেশে দেশে প্রতিযোগিতা কমিশনগুলো ঠিকমতো কাজ করলে জরুরি পণ্যের দাম বাড়ানো বা জনস্বার্থবিরোধী সিন্ডিকেট করা এত সহজ হয় না। তাই এ ধরনের কমিশন ভোক্তা ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষার জন্য খুবই দরকারি। গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্যও জরুরি।

অথচ আমাদের এখানে প্রতিযোগিতা কমিশনটিকে পঙ্গু বানিয়ে মাঠে নামানো হয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার-সংরক্ষণ অধিদপ্তর নামের একটি ‘সার্কাস’কে। বড় বড় কোম্পানি এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের অনৈতিক বাজার কর্মকাণ্ড নিয়ে তাদের কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারা বিভিন্ন টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান সঙ্গে নিয়ে ঘোরে এবং তাদের প্রধান কাজ মিডিয়ার সামনে খুচরা পর্যায়ের (রিটেইলার) ডিমওয়ালা-ডাবওয়ালাকে কানে ধরে ওঠবস করানো। অথচ বাংলাদেশের অনেকগুলো মিডিয়ার মালিক যে বাজার কারসাজির সঙ্গেও জড়িত, এই তথ্য জনগণের সামনে আনার মতো সাহস তাদের নেই।

আরও পড়ুন

এত কিছুর সংস্কার হচ্ছে, এত এত পরিবর্তনের রূপরেখা, অথচ আমাদের ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ আলাপ থেকে কৃষি, কৃষক ও সাধারণ ভোক্তার অর্থনৈতিক স্বার্থের আলাপ হাওয়া করে দেওয়া হয়েছে। এমনিতেই প্রতিটি কৃষি উপকরণের দাম বাড়ছে অন্যায্য প্রক্রিয়ায়। বিআইডিএস বলছে, সাত বছরে দেশে সার, বীজসহ কৃষি উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ। তার ওপর আওয়ামী আমলের ‘অলিগোপলি’ ও বৃহৎ পুঁজির অনৈতিক দাপট ঠিক আগের মতোই কার্যকর। তেল, বীজ বা আলুর মতো জরুরি খাদ্যপণ্য বা আড়তের মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে বর্তমান সরকারের উল্লেখ করার মতো একটি কার্যকর উদ্যোগও আমরা দেখিনি।

অথচ বাজারে ভারসাম্য রাখতে এবং জিনিসপত্রের দাম নাগালের মধ্যে রাখতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের কথা ছিল প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা অথবা তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে আনা। উচিত ছিল প্রতিযোগিতা কমিশনকে সক্রিয় করা, ঘোষণা দিয়ে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ানো, চালের আড়তের মালিকদের সঙ্গে স্টোরেজ ব্যবহারের চুক্তি করা এবং মধ্য মেয়াদে সরকারের নিজস্ব মজুতের সক্ষমতা বাড়ানো।

এ ছাড়া আলু, ফুলকপি বা অন্যান্য শীতের সবজি উৎপাদনে কৃষক যেহেতু বারবার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সবজি কেনার ব্যবস্থা করা এবং সবজি হিমাগারের বেসরকারি অবকাঠামো ব্যবহার করার চুক্তি করা। এগুলো তো বহুল আলোচিত সমাধান, কৃষকদের বহুদিনের দাবি। আর এত কিছুর সংস্কার যেহেতু হচ্ছে, এ সুযোগে সবচেয়ে জরুরি সংস্কারটিও করে ফেলুন। টিসিবির পণ্য, খাদ্যপণ্য বা কৃষিপণ্য কেনাকাটা–সম্পর্কিত সব কটি কাঠামোকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন থেকে বের করে আনুন। কারণ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তার স্বভাব ও ইতিহাস অনুযায়ী কোটিপতি ব্যবসায়ীদের স্বার্থটাই দেখবে। টিসিবি, রেশনিং বা সরকারি ক্রয়ের মতো জনস্বার্থের কাজ খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে হতে হবে।

অথচ বড় কোম্পানি বা বৃহৎ পুঁজির মালিকের গায়ে আঁচড় কাটার মতো কোনো মেকানিজম তৈরি করা হলো না। উল্টো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদকদের উৎপাদনের একাধিক পর্যায়ে (আমদানি, উৎপাদন ও রিটেইলিং) দফায় দফায় উচ্চ হারে ভ্যাট বসানো হলো। ছোটখাটো ব্যবসায়ীদের জন্য এখন টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বহু দরিদ্র শ্রমজীবী তরুণের রক্তের বিনিময়ে আমরা নতুন একটি সরকার পেয়েছি। ছয় মাস পার হওয়ার পরও এই সরকার যদি সিন্ডিকেট ভাঙার প্রশ্নে ন্যূনতম ‘পলিটিক্যাল উইল’ বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে না পারে, জনগণের জরুরি খাদ্য কেনাকাটায় এতটুকু স্বস্তি ফেরাতে না পারে, বরং উল্টো বিদেশি সংস্থার ‘প্রেসক্রিপশন’ মেনে অসহায় মানুষের ওপর আরেক দফা উচ্চ ভ্যাট বসায়, তাহলে এত বড় বড় উচ্চাভিলাষী সংস্কারের আলাপ, অথবা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রতিশ্রুতি বড় ফাঁপা শোনায়।

  • মাহা মির্জা লেখক ও গবেষক