কুকি-চিন মানুষদের নিয়ে মিজোরামের রাজধানী আইজল খুব উত্তাল যাচ্ছে গত কয় দিন। মিছিল-মিটিং হচ্ছে। রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারকে স্থানীয় মিজোরা বাংলাদেশের কুকি-চিনদের উদারভাবে আশ্রয় দিতে বলছে। মিয়ানমারের পালিয়ে আসা চিনদের জন্যও তারা একই নীতি চায়। এ দাবির পেছনে রয়েছে বিস্তর ঘটনা—আর সামনে আছে সম্ভাব্য আরও কিছু অধ্যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের সেসব বিষয়ে কতটা অবহিত ও সতর্ক?
মিজোরামে যখন কুকি-চিন প্রসঙ্গ
মিজোরা যাদের কুকি-চিন বলছে, বাংলাদেশে তারা হলো বম, লুসাই, পাংখোয়া ইত্যাদি। সংখ্যায় খুব কম এসব জাতিগোষ্ঠী। বান্দরবান সদর, রুমা, রোয়াংছড়ি, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল অঞ্চলে এদের বেশি বসবাস, যা মিয়ানমারভুক্ত চিন প্রদেশ এবং ভারতভুক্ত মিজোরাম-সংলগ্ন। বান্দরবানের কাছাকাছি মিজোরামের জিলার নাম লঙ্গৎলাই। আর চিনের অংশ পালেতওয়া টাউনশিপের মাটুপি। কাছেই আরাকানের মংডু।
ইতিমধ্যে হয়তো কিছু দেরিই হলো। অনেক বেশি দেরি হলো কি না, কে জানে! তবে সশস্ত্রতায় সমৃদ্ধি মেলে কি? বরং ‘পার্টি’র সংখ্যা বাড়তে থাকলে শান্তিতে টান পড়তে বাধ্য। ঠিক একই কারণে ঘরের কথা আইজল যায়। জাতিতে জাতিতে দূরত্ব বাড়ে। পাহাড় নিয়ে কোনো তরফ থেকেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ঘাটতি না হওয়া কাম্য। বিশেষ করে গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা-অ্যাক্ট’ পাস হওয়ার পর যখন মিয়ানমারের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চার ধরনের প্রশাসনিক পরিচয় নিয়েও এ অঞ্চলে রয়েছে বহু জাতিসত্তার মানুষ। বহুকাল ধরে এ রকম জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে নৃতাত্ত্বিক বন্ধন ঘিরে নানান ভাঙা-গড়া-সংঘাত-সংঘর্ষ ছিল এবং আছে। তার মধ্যে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের মিশেলও যুক্ত হয় প্রতিনিয়ত। সে রকমই এক চলতি অধ্যায়ে আইজলে এক সপ্তাহ ধরে মিজোরা বাংলাদেশের কুকি-চিনদের ব্যাপারে সমব্যথী হয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করছে। ঢাকায় সে খবর হয়তো সামান্যই এসে পৌঁছাল।
‘জো’দের পারস্পরিক বন্ধনকে বিবেচনায় রাখা দরকার
‘মি-জো’ কথার মানে ‘পাহাড়ের মানুষ’। এটা বেশ বিস্তৃত ধারণা। এতে অনেক জাতিসত্তা অন্তর্ভুক্ত। এসব জাতিসত্তা নিজেদের বলে ‘জো’। আইজলের মিজোদের বক্তব্য হলো কুকি-চিনরাও জো। সুতরাং তারা বিপদে পড়ে যদি মিজোরামে ঢুকে থাকে, তাহলে এদের তাড়ানো যাবে না। মিজোরামের এখনকার সরকার এ রকম মনোভাব সমর্থন করে। তবে সীমান্তরক্ষীরা কেন্দ্রীয় সরকার-নিয়ন্ত্রিত। ফলে সীমান্তে অন্য দেশের জোরা বাধা পাওয়ায় আইজল ক্ষুব্ধ। এর আগে অবশ্য মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে চিন থেকে প্রচুর জো মিজোরামে ঢুকে আছে।
যেহেতু চিন, বান্দরবান, মিজোরাম মিলে জোদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী বেশি, সে কারণে আইজলের রাস্তায় দাঁড়ানো মানুষদের মধ্যে একটা ধর্মতাত্ত্বিক শক্ত বন্ধনও কাজ করছে। বম, পাংখোয়া, লুসাইরা ‘ব্রিটিশ খ্রিষ্টান’ হিসেবে পরিচিত। প্রায় ১০০ বছর হলো প্রকৃতি পূজারি থেকে তাঁদের ধর্মান্তরের। কিন্তু ‘বম’ শব্দের অর্থ যে বন্ধন—তার সামাজিক চেহারা একই রকম আছে। আশপাশের দেশের অ-বমদের সেটা মনে না রাখলে ভুল করা হবে।
জটিল হচ্ছে জাতিগত সমীকরণ
ভারতবর্ষ এবং মিয়ানমারের দখল, কাটাছেঁড়া, ‘মুক্তি’—সবই ঘটেছে ব্রিটিশদের হাতে। শত শত বছরের পুরোনো নৃতাত্ত্বিক বাস্তবতা এসব কাটাছেঁড়ায় মুশকিলে পড়েছে। অনেক সময় প্রশাসনিক মুশকিলে ভৌগোলিক এসব ত্রিমোহনার মানুষকে সীমান্ত পেরোতেও হয় আইন-আদালতের কথা ভুলে।
এ রকম বিবিধ প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে মিজোরামে পাঁচ দশক আগে থিতু হওয়া প্রচুর চাকমাও আছেন। বৌদ্ধ চাকমাদের সঙ্গে ওদিকে আবার খ্রিষ্টান মিজোদের সম্পর্ক মধুর নয়। সেই অমধুর সম্পর্কের জের দেখা গেল আইজলে সাম্প্রতিক কুকি-চিনকেন্দ্রিক সমাবেশগুলোয়। ইয়াং মিজো অ্যাসোসিয়েশনের (ওয়াইএমএ) কর্মীরা বলছেন, অতীতে চাকমাদের বিষয়ে প্রশাসন যতটা উদার ছিল, কুকি-চিন বা জোদের বিষয়ে একই রকম হতে সমস্যা কোথায়? বোঝা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলে একটা জো জাতীয়তাবাদ কাজ করছে।
এর প্রবল সমর্থন আছে আবার চিন প্রদেশের চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (সিএনএফ) দিক থেকে। সেখানে পালেটোয়া শহরটির ওপর অধিকার নিয়ে চিনদের সঙ্গে রাখাইনদের ব্যাপক বিরোধ যাচ্ছে। ওই রাখাইনদের সংগঠন আরাকান আর্মির নাম চলে এসেছে আবার সাম্প্রতিক কুকি-চিন সমস্যায়। এ কারণে জটিল এক জাতিগত সমীকরণে ঢুকছে এ পুরো অঞ্চল নতুন করে। তাতে ২০২২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর জো বনাম রাখাইন ইতিহাসে নিশ্চিতভাবে নতুন কিছু যোগ করল।
পাহাড়ে প্রজ্ঞার ঘাটতি যেন না হয়
জোদের একাংশ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে কেন ‘কুকি-চিন’ নাম পেল, তার কলোনিয়াল ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। ঢাকা, নয়াদিল্লি কিংবা মিয়ানমারের নেপিডোতে এসব নিয়ে এখন খুব আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। তবে বাংলাদেশে হঠাৎ কুকি-চিনদের একটা সংগঠনের নাম শোনা যাচ্ছিল পত্রপত্রিকায়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযানের খবরও শোনা যাচ্ছে।
কুকি-চিনরা কীভাবে ছোট জাতিসত্তা থেকে এ রকম বড় সংগঠনের জাতীয় ‘গল্প’ হয়ে উঠল, সেটার পেছনে ছুটলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা অনেক কিছু পাবেন। সেসব অনুসন্ধান হলে কেএনএফ (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) এর আকার-আকৃতি নিয়ে চালু গল্পের ফুলেফেঁপে থাকা মেদ কমতে পারে। কিন্তু সংখ্যায় যা–ই হোক, কেএনএফ দূরদূরান্তে থাকা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সহানুভূতি ও উৎসাহ পেয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কেএনএফ সদস্যরা মিয়ানমারের চিন রাজ্যের ভিক্টোরিয়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদর দপ্তরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে শোনা যায়। এরপর এই কুকি-চিন তরুণেরা আরও প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারের কাচিন পর্যন্ত গেছে—এমন কথাও চালু রয়েছে। এগুলো সবই যাচাই অযোগ্য দাবি। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য যে চিন ও ‘কুকি’রা নৃবিজ্ঞানে একই অধ্যায়ে আছে। এশিয়ার এ অঞ্চলে এরা সবাই মিলে মোটেই ছোট কোনো জাতিশক্তি নয়। এটা খেয়াল না করলে সমস্যা বাড়তে পারে।
ইতিমধ্যে যা ঘটেছে, বম-পাংখোয়া-লুসাই পাড়াগুলো আর আগের মতো নেই। এ বছর ‘ফাথার বুহ তেম’ (নবান্ন) উৎসবও হলো না। উল্টো গ্রাম বা খোয়াগুলো এখন অনেক মাচাং বাসিন্দাদের অপেক্ষা করছে।
লক্ষণ হিসেবে এসব অশুভ। আইজলে কে কী বলছে—শোনা দরকার। বম, লুসাইসহ এ রকম সবার মধ্যে আস্থা ফেরাতে হবে। সংলাপ দরকার। পারস্পরিক দরদে হয়তো ঘাটতি পড়েছে।
পার্বত্য এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু অনেকে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের কাছে অনেক কিছু আশা করে থাকবে। কিন্তু ২৫ বছর পরও তাদের প্রান্তিকতা ঘোচেনি বলে দীর্ঘশ্বাস ছিল। সেই শ্বাস-প্রশ্বাসকে চাকমা থেকে বাঙালি অনেকের প্রয়োজনীয় মনোযোগ পেয়েছিল কি না, সে সন্দেহ উঠছে এখন।
ইতিমধ্যে হয়তো কিছু দেরিই হলো। অনেক বেশি দেরি হলো কি না, কে জানে! তবে সশস্ত্রতায় সমৃদ্ধি মেলে কি? বরং ‘পার্টি’র সংখ্যা বাড়তে থাকলে শান্তিতে টান পড়তে বাধ্য। ঠিক একই কারণে ঘরের কথা আইজল যায়। জাতিতে জাতিতে দূরত্ব বাড়ে। পাহাড় নিয়ে কোনো তরফ থেকেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ঘাটতি না হওয়া কাম্য। বিশেষ করে গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা-অ্যাক্ট’ পাস হওয়ার পর যখন মিয়ানমারের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক