চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা: বর্ষা সামনে রেখে যা করছি, যা করতে হবে

টানা বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম পানিতে ডুবে যায়। নগরবাসী ভোগান্তিতে পড়েনছবি: প্রথম আলো

জনদুর্ভোগ কমানো অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অন্যতম প্রধান কাজ। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নাগরিক দুর্ভোগের একটি অন্যতম কারণ। এটি লাঘবের লক্ষ্যে আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে কী করা যায়, তা নির্ধারণের জন্য আদিল ভাই (আদিলুর রহমান খান), রিজওয়ানা আপা (সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান), ফারুক-ই-আজম ভাই, আসিফ (আসিফ মাহমুদ) ও আমাকে প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব দেন। আমরা সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং এর সমাধান বিষয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও সংস্থা, শিক্ষক, গবেষকসহ অন্য অংশীজনদের সঙ্গে ৫ জানুয়ারি ঢাকায় একটি সভায় মিলিত হই। পরে ১৮ জানুয়ারি আমরা সরেজমিন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করি এবং সমস্যার কারণ ও ব্যাপকতা অনুধাবনে সচেষ্ট হই। পরের দিন সরকারি দপ্তর ও সংস্থা, শিক্ষক, গবেষকসহ অন্য অংশীজনদের সঙ্গে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মতবিনিময় সভায় আবার মিলিত হই।

কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর দেশের অন্যান্য শহর থেকে কিছুটা ভিন্ন। নগরী ও এর আশপাশে বেশ কিছু টিলা ও পাহাড় ছিল। বৃষ্টির পানি অপসারণের জন্য ছিল ৫৭টি খাল। ভূমি ঢালু বিধায় বৃষ্টির পানি খাল বেয়ে দ্রুত নেমে যেত। নিজে চট্টগ্রামে বড় হয়েছি বিধায় শৈশব থেকে তা–ই দেখে এসেছি। তাহলে এখন এ জলাবদ্ধতা কেন?

জলাবদ্ধতার কারণ

চট্টগ্রাম নগরীতে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ দুটি—এক. নির্বিচার পাহাড় কাটা; দুই. খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া। পাহাড় কাটার কারণে একদিকে ঢালু জমি সমতল হওয়ায় পানি আটকে থাকছে। আবার পাহাড়ের বালু খালের তলদেশে জমা হয়ে খালের গভীরতা কমাচ্ছে এবং বৃষ্টি ও বন্যার পানি অপসারণের ক্ষমতা হ্রাস করছে। এ ছাড়া খালের বিএস সীমানার ভেতরে অবৈধ ভবন নির্মাণ করায় এটির প্রশস্ততা কমে বৃষ্টি ও বন্যার পানি অপসারণের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সর্বশেষ কারণটি হলো, নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবনতি। ড্রেনগুলো আবর্জনা খালগুলো ভরাট করে ফেলেছে। বর্জ্যের মধ্যে সবচেয়ে সর্বনাশা হলো পলিথিন ব্যাগ ও পিইটি বোতল। পরিদর্শনকালে আমরা দেখতে পাই, খালের উপরিভাগ এসব বর্জ্যে ছেয়ে আছে।

ওপরের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট ও প্রকৃতির প্রতিশোধ। 

করণীয় কাজ

ঢাকায় প্রথম সভায় সবার সঙ্গে আলোচনা করে আগামী বর্ষার আগে ৯টি করণীয় চিহ্নিত করে কোন কাজটি কার দায়িত্ব, কীভাবে করা হবে এবং কাজটি করতে কী সহায়তা লাগবে, সে বিষয়ে একটি ম্যাট্রিক্স ও গ্যান্ট চার্ট প্রণয়ন করে বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার কাছে পাঠানো হয়। করণীয় কাজগুলো হলো: (ক) চট্টগ্রাম শহরের সব ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করা, (খ) চট্টগ্রাম শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কারের ব্যবস্থা নেওয়া, (গ) পানিনিষ্কাশনের জন্য নির্মাণাধীন স্লুইসগেট–রেগুলেটরগুলোর নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, (ঘ) চট্টগ্রাম শহরের খালগুলো পরিষ্কার করা, খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে এগুলোর খননকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা, (ঙ) যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলা বন্ধ করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া, (চ) কর্ণফুলী নদীর প্রয়োজনীয় নাব্যতা ও গভীরতা বজায় রাখার জন্য মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করা এবং (ছ) জলাবদ্ধতার হটস্পটগুলোয় পাম্পহাউস চালু করা। এসব কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রভৃতি সংস্থাকে। 

আগামী চার মাসের কর্মপরিকল্পনা 

পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা বিষয়ে চলমান বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন শেষে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা পরদিন তাদের আগামী চার মাসের কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করে। কর্মপরিকল্পনার ওপর আলোচনা শেষে নিম্নরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 

(১) পাহাড় কাটা বন্ধে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ অবিলম্বে ব্যবস্থা নেবে, এসব এলাকায় বিদ্যুৎ ও ওয়াসার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। (২) পলিথিন ও পিইটি বোতলের ব্যবহার সীমিত করে এগুলো রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। (৩) সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষে সেনাবাহিনী কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে, যাতে আগামী বর্ষার আগে নগরবাসী এর সুফল পেতে পারে। (৪) পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের স্লুইসগেটগুলোর অপ্রশস্ততা ও স্থাপিত পাম্পগুলোর নিম্ন ক্ষমতা বিষয়ে আলোচনা হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। (৫) চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জলাবদ্ধতা নিরসনের কথা মাথায় রেখে মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা জোরদার করবে, যাতে বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে যায়। (৬) পানিপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কালভার্টগুলোর উচ্চতা বাড়ানো হবে এবং ওয়াসা ও অন্যান্য ইউটিলিটির লাইন সরিয়ে নেওয়া হবে। সংস্থাগুলোকে বলা হয়েছে, কর্তব্য পালনে ব্যর্থ ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং বর্তমান কার্যক্রমের সাফল্যের ভিত্তিতে চলমান প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

দাবিকৃত ও প্রতিশ্রুত সহায়তা

উপস্থাপনাকালে (ক) অবৈধ দখলদারদের দায়েরকৃত বিচারাধীন বিভিন্ন মামলার নিষ্পত্তি বিষয়ে সহায়তা কামনা করা হয়। (খ) এ ছাড়া যত্রতত্র ময়লা ফেলা থেকে নাগরিকদের বিরত রাখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদস্থ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। (গ) সবশেষে (১) চট্টগ্রাম শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা ও পরবর্তী সময়ে (২) শহরবাসী যাতে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলে, সে জন্য শ্রেণিভিত্তিক বর্জ্য আলাদা করে সংগ্রহ করে তা ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করার জন্য থোক বরাদ্দ প্রদানের ও (ঘ) একটি সমন্বয় কমিটি গঠনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়। আলোচনাকালে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত একটি রাজনৈতিক দলের নেতা তাঁর দলকে দায়িত্ব দিলে তঁারা কয়েক কিলোমিটার ড্রেন স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম হিসেবে বিনা মূল্যে পরিষ্কার করার প্রতিশ্রুতি দেন।        

আমাদের পক্ষ থেকে মামলার নিষ্পত্তি, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদস্থ করা, সমন্বয় কমিটি গঠন ও থোক বরাদ্দ প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। ইতিমধ্যে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা ও শহরবাসী যাতে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলে, শ্রেণিভিত্তিক বর্জ্য আলাদা করে সংগ্রহ করে, তা ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করার জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সিটি করপোরেশনকে বিশেষ থোক বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও চট্টগ্রামের মেয়র আগামী ১ ফেব্রুয়ারি সেখানে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করবেন। অনতিবিলম্বে অবৈধ দখলদারমুক্ত করার বিষয়ে আইনি সহায়তা প্রদান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদস্থ করা হবে।

সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে

আগেই বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট ও প্রকৃতির প্রতিশোধ। তাই এটা মোকাবিলায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নগরীর বাসিন্দাদের পাহাড় ও খালখেকোদের সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে হবে, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ ও পিইটি বোতলের পরিবর্তে কাচের জগ ব্যবহার করতে হবে। না হলে বর্তমানে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয়িত প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের দ্বিগুণ বা তিন গুণ ব্যয় করলেও এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। এসব বিষয়ে আমরা নগরবাসীর সহায়তা চাই। তাহলেই প্রধান উপদেষ্টার আন্তরিক এ উদ্যোগ সফল হবে এবং চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা লাঘব হবে।    

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, সেতু ও রেলওয়েবিষয়ক উপদেষ্টা