সংবাদমাধ্যমে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জীবনে থেমে থাকার অবকাশ একেবারে নেই বললেই চলে। ঘটনা-দুর্ঘটনা ছুটির দিন বলে যেহেতু বিরতি নেয় না, সেহেতু সংবাদকর্মীদের সেসব দিনেও পরিবার, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে খবরের পেছনে ছুটতে হয়। বছরের ৩৬৫ দিনের একটি দিনেও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। টেলিভিশন ও রেডিওতে তাই বার্তাকক্ষে কখনোই কোনো ছুটি ছিল না, এখনো নেই। বর্তমানে যোগ হয়েছে অনলাইন বা মাল্টিমিডিয়া পোর্টাল। সেখান থেকেও ‘ছুটির দিন’ কথাটা নির্বাসিত।
সংবাদপত্রে অবশ্য জাতীয় ছুটি, বিশেষত ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসবের দিনগুলোয় ছুটির প্রচলন আছে। এর কারণ মূলত ছুটির দিনে পত্রিকা বিতরণব্যবস্থার সমস্যা। তবে আমাদের দেশেই সম্ভবত ধর্মীয় ও জাতীয় উৎসব মিলিয়ে ছুটির দিন অন্যদের তুলনায় বেশি। যুক্তরাজ্যে খ্রিষ্টধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিনে কোনো পত্রিকা ছাপা হয় না।
তবে ২৬ ডিসেম্বর কাগজ ছাপা হয় বলে ২৫ তারিখে পত্রিকা অফিস খোলা থাকে। বন্ধ থাকে মূলত ২৪ ডিসেম্বর। কয়েকটি কাগজ নববর্ষের দিন এবং ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস নববর্ষ, গুড ফ্রাইডে ও বক্সিং ডেতে ছাপা হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কোনো পত্রিকা এক দিনের জন্যও বন্ধ থাকে না। আবার কোনো কোনোটি কিছু কিছু উৎসবের দিন বন্ধ থাকে। ভারত ও পাকিস্তানে পত্রিকার মুদ্রণ বন্ধ থাকার দিন আমাদের চেয়ে কম।
পত্রিকা ছাপা বন্ধ থাকার মানে অবশ্য এই নয় যে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীরা যন্ত্রের মতো সব দিনই কাজ করেন। বরং কাজ বণ্টন হয় চক্রাকারে, যাতে সবাই কোনো না কোনো সময়ে তাঁদের প্রাপ্য ছুটি ভোগ করতে পারেন। অন্তত সেটাই হওয়ার কথা।
পেশাগত চাহিদা এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য তৈরির বিষয়টির গুরুত্ব কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না এবং তা নিশ্চিত করার কাজটি পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ও ইউনিয়নের বোঝাপড়ার বিষয়। যুক্তরাজ্যে মূল পত্রিকাগুলো রোববার বন্ধ রাখার জন্য প্রায় সব পত্রিকার আলাদা ব্যবস্থা আছে, আলাদা টিম আছে, যারা শুধু রোববারের কাগজের জন্য কাজ করেন। ফলে টেলিগ্রাফ, টাইমস বা গার্ডিয়ান রোববার বের হয় না, তার বদলে ছাপা হয় সানডে টেলিগ্রাফ, সানডে টাইমস ও সানডে অবজারভার। ট্যাবলয়েডগুলোর ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা।
জাতীয় ছুটির দিনগুলোয় পত্রিকা চালু রাখার জন্য সাংবাদিক ও অন্য কর্মীদের জন্য বাড়তি পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু পাঠকের কাছে খবর পৌঁছানোর ধারায় কোনো ছেদ ঘটে না।
একটু ভেবে দেখুন তো, পাঠক যদি এখন ভাবেন যে একটা দেশ যদি ৬ দিন পত্রিকা ছাড়া চলতে পারে, তাহলে ৩৬৫ দিন চলতে পারবে না কেন? পাঠকের অভ্যাস বদলে ফেলার সুযোগ দেওয়া কি সংবাদপত্রশিল্পের জন্য আত্মঘাতী হয়ে গেল না? কোভিডের সময় ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে সংবাদপত্র পাঠক হারিয়েছে কী পরিমাণে, তা নিশ্চয়ই সংবাদপত্রশিল্পের কারও অজানা নেই। সেই ধাক্কা গত দুই বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এখন আবার সে রকম ক্ষতি ডেকে আনা কেন?
ভারতে রাজ্যভেদে পূজার ভিন্নতা থাকায় ছুটিতেও ভিন্নতা আছে। যেমন দুর্গাপূজার ছুটি মহারাষ্ট্রে মিলবে না। পশ্চিমবঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকা ছাপা হয় না বছরে মোট ৮ দিন। পাকিস্তানি সাংবাদিক জুবায়ের কুরেশির কাছে জানলাম, সেখানে দুই ঈদে দুদিন করে এবং ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও পবিত্র আশুরায় এক দিন করে মোট ছয় দিন পত্রিকা বের হয় না।
ছাপা পত্রিকার প্রতি পাঠকের আকর্ষণ একেবারেই অভ্যাসগত একটা বিষয়। আগে বলা হতো, পাঠক পত্রিকা পড়ে রেডিও-টিভিতে যা পাওয়া যায় না, তা জানার জন্য। খবরের পেছনের খবর, খুঁটিনাটি বিবরণ, বিশ্লেষণ ইত্যাদি জানার আগ্রহ থেকে পত্রিকার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতো। কিন্তু এখন অনলাইনের অফুরন্ত পরিসরে দীর্ঘ প্রতিবেদন বা নিবন্ধ প্রকাশ সহজ হয়ে যাওয়ায় তা ছাপা পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্র অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ছে। পত্রিকাগুলো তাই ছাপানো সংস্করণের পাশাপাশি অনলাইনেও মনোযোগ ও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। কিন্তু তাই বলে কি ছাপা পত্রিকার অপমৃত্যু ডেকে আনতে হবে?
যেসব পত্রিকা শুধু ডিক্লারেশন টিকিয়ে রাখার জন্য প্রকাশিত হয়, তাদের জন্য পত্রিকা যত কম দিন ছাপা হয়, ততই মঙ্গল। কেননা, তাতে তাদের খরচ বাঁচে। কিন্তু মূলধারার পত্রিকাগুলোর বেলায় তো এ কথা চলে না। বরং এই উৎসবের সময় কাগজ বেশি দিন ছাপা হলে তাদের বিজ্ঞাপন থেকে আয়ে প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা। সরকারি ছুটি ঠিক রেখে বিশেষ ব্যবস্থায় পত্রিকা ছাপানোর সিদ্ধান্ত তো আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি এবং সেটাই স্বাভাবিক।
শনিবার বিকেলে জানা গেল, সংবাদপত্র মালিকদের সমিতি নোয়াব এবারে ঈদ ও বাংলা নববর্ষ মিলিয়ে একটানা ছয় দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে। ৯ থেকে ১৪ এপ্রিল পত্রিকাগুলোয় এ ছুটি কার্যকর হবে, যার ফলে ১০ থেকে ১৫ এপ্রিল পাঠক কোনো ছাপা পত্রিকা হাতে পাবেন না। অথচ ছুটির সময়ে আলস্যভরা সকালে এক কাপ চায়ের সঙ্গে একখানা পত্রিকা পাঠকের সঙ্গী হলে ছাপা কাগজে কিছুটা হলেও আগ্রহ ফেরানোর চেষ্টা থাকত।
একটু ভেবে দেখুন তো, পাঠক যদি এখন ভাবেন যে একটা দেশ যদি ৬ দিন পত্রিকা ছাড়া চলতে পারে, তাহলে ৩৬৫ দিন চলতে পারবে না কেন? পাঠকের অভ্যাস বদলে ফেলার সুযোগ দেওয়া কি সংবাদপত্রশিল্পের জন্য আত্মঘাতী হয়ে গেল না?
কোভিডের সময় ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে সংবাদপত্র পাঠক হারিয়েছে কী পরিমাণে, তা নিশ্চয়ই সংবাদপত্রশিল্পের কারও অজানা নেই। সেই ধাক্কা গত দুই বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এখন আবার সে রকম ক্ষতি ডেকে আনা কেন? অনলাইন চালু থাকা মানে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের একটা বড় অংশ কার্যত এসব দিনে কাজ করবেন। শুধু ছুটিতে থাকবেন পত্রিকা বিতরণকারী হকাররা।
বিশ্বজুড়ে এখন ২৪ ঘণ্টার অর্থনীতির দাপট। অনলাইনে ব্যবসার সুবাদে খুচরা ব্যবসায়ও এখন রাত-দিনের ফারাক থাকে না। রাতের বেলায় অনলাইনে জিনিস পছন্দ করে দাম পরিশোধ করে দিলে পরদিনই তা ঘরের দরজায় পৌঁছে যায়। প্রযুক্তিনির্ভর এ অর্থনীতিতে ঘরে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সেবা অত্যন্ত জনপ্রিয়। কে, কত দ্রুত পৌঁছে দিতে পারে, তার প্রতিযোগিতাই এখন মুখ্য হয়ে উঠছে। সুতরাং খবরের কাগজ পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে না পারলে সংবাদপত্রশিল্প কীভাবে টিকবে, সে প্রশ্ন এখন পত্রিকার মালিকদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা প্রয়োজন।
হকাররা ছুটির দিনে পত্রিকা বিতরণে আগ্রহী নন—এ যুক্তি কি এখন চলে? মুঠোফোনের অ্যাপে অর্ডার করে রেস্তোরাঁর গরম-গরম খাবার যখন বাসায় বসেই পাওয়া যায়, তখন পত্রিকা বিতরণব্যবস্থা কি সেকেলে পদ্ধতিতে জিম্মি হয়ে থাকবে? শুধু বিতরণব্যবস্থার সমস্যার কারণে সংবাদপত্র নিজেরাই নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয় করে তুলছে কেন?
● কামাল আহমেদ সাংবাদিক