২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

পৌনে ২০০ বছরেও শেষ হলো না সাঁওতালদের হুল!

শিল্পীর তুলিতে সাঁওতাল বিদ্রোহ
ছবি: সংগৃহীত

সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হুল বললেই প্রথমে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সিধু-কানুর কল্পিত মুখের অবয়ব, যে অবয়বে ফুটে আছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়।

প্রায় পৌনে ২০০ বছর আগে অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের সাঁওতালদের ছিল না কোনো শিক্ষাদীক্ষার আলো বা মৌলিক অধিকারের সুযোগ। কিন্তু ইংরেজ শাসক আর তাদের দোসর সুদখোর অত্যাচারী জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের অন্যায়, অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাঁওতালেরাই প্রথম রুখে দাঁড়িয়েছিল।

ইংরেজ শাসক–শোষকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম স্ফুলিঙ্গটি বিস্ফোরিত হয় ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন। ওই দিন ১০ হাজারের বেশি সাঁওতাল নিয়ে সিধু-কানুর নেতৃত্বে এক প্রতিবাদ সমাবেশ ও কলকাতা অভিমুখে গণপদযাত্রা করা হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, সিধু-কানুর নেতৃত্বে এ গণপদযাত্রাই উপমহাদেশের প্রথম পদযাত্রা, যা পরবর্তী সময় শান্তিপূর্ণভাবে যেকোনো দাবি আদায়ের একটি অন্যতম পন্থা হয়ে উঠেছে, যেটি বর্তমানে ‘লংমার্চ’ নামে সর্বাধিক পরিচিত।

কৃষক বিদ্রোহ বা প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর আন্দোলনে অনেক দুর্বলতা ছিল এ কথা স্বীকার করতে হবে। কেননা, শ্রমজীবী পেশার মানুষদের মধ্যে সুগঠিত হয়ে আন্দোলন সফল করার অভিজ্ঞতা সেসব আন্দোলনে ছিল না। কিন্তু শাসকশ্রেণির শোষণ-উৎপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই তারা সংগঠিত হয়ে শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছিল। তাই কৃষক বিদ্রোহ বা জাতিসত্তাগুলোর আন্দোলন সফল হয়েছে, নাকি পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটেছে, সেটা মুখ্য বিষয় নয়।

শত বছর আগে যে স্বপ্ন আর আশা নিয়ে সাঁওতালেরা বিদ্রোহ করেছিলেন, সেই স্বপ্ন আজও তাঁদের কাছে অধরাই রয়ে গেছে। ১৮৫৫ সালে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ শাসক ও জোতদার শ্রেণির অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাঁওতালেরা। অথচ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও সাঁওতালদের (গোবিন্দগঞ্জের) নিজেদের অস্তিত্ব ও অধিকারের জন্য এখনো লড়াই করে যেতে হচ্ছে, প্রাণ দিতে হচ্ছে!

এ দেশে সাঁওতাল, মুন্ডা, কোচ থেকে শুরু করে পাহাড়ের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, খিয়াং, ওঁরাওদের প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নিপীড়ন, নির্যাতন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হচ্ছে।

সময়ের পরিক্রমায় অবিভক্ত ভারতবর্ষ খণ্ড–বিখণ্ড হয়েছে। ক্ষমতার মসনদে নেতৃত্বের পালাবদল ঘটেছে। এ উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশরা বহুকাল আগেই চলে গেছে, কিন্তু আজও শাসকগোষ্ঠীর মগজে–মননে শোষণের সেই বিষয় বিচরণ করছে! তাই কেবল সাঁওতালেরা নন, পাহাড়-সমতলের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীই আজ বৈষম্য আর বঞ্চনা-নির্যাতনের শিকার।

সাঁওতাল বিদ্রোহটি ছিল মূলত অসম একটি বিদ্রোহ। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সুশৃঙ্খল বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের কাছে সিধু-কানুদের তির-ধনুক ছিল নিতান্তই ঠুনকো অস্ত্র। কিন্তু এ তির-ধনুক দিয়েই লড়াকু সাঁওতালেরা শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

আধুনিক অস্ত্রের কাছে আট মাসের মাথায় বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হলেও সাঁওতালেরা তাঁদের অধিকার আদায়ের দাবি থেকে সরে আসেননি। মূলত, ইংরেজ শাসক ও জোতদার শ্রেণির বিরুদ্ধে সাঁওতালদের এ সংগ্রামের ইতিহাস তাঁদের লড়াকু চরিত্রের বৈশিষ্ট্যকেই বহন করে।

সাঁওতাল বিদ্রোহ যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বীজ বুনেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই তো শাসকশ্রেণির শোষণ ও বৈষম্য থেকে মুক্তির যে মশাল সাঁওতালেরা জ্বালিয়েছিলেন, সেই মুক্তির মশাল ছড়িয়ে পড়েছিল সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭), নীল বিদ্রোহ (১৮৬০-৬১), মুন্ডা আন্দোলন (১৮৯৯-১৯০০), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭), হাজং বিদ্রোহ ও ত্রিপুরা বিদ্রোহের (১৮৪৪-৯০) মতো আন্দোলনগুলোয়।

শিল্পীর তুলিতে সাঁওতাল বিদ্রোহ
ছবি: সংগৃহীত

সাঁওতাল বিদ্রোহের আগে আরও কিছু বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, যেগুলো ইতিহাসের পাতায় নিবু নিবু করে টিকে আছে। যেমন চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-১৭৮৭), খাসি বিদ্রোহ (১৭৮৩), কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২), গারো বিদ্রোহ (১৮৩৭-১৮৮২) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

অবিভক্ত ভারত ও পরবর্তী সময় খণ্ডিত ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও জাতিসত্তাগুলোর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমরা নারীর উপস্থিতিও লক্ষ করেছি, যাঁরা আন্দোলনের সামনের সারির নেতৃত্বে ছিলেন। সাঁওতাল বিদ্রোহে সিধু-কানুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁদের বোন ফুলো মুরমু ও ঝানো মুরমুর সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। সিধু-কানুদের মতো ফুলো মুরমুকেও ব্রিটিশ সেপাইরা নৃশংসভাবে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।

তেভাগা আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলনের মতো আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রানি কালিন্দীর (১৮৪৪-১৮৭৩) কথাও গর্বভরে স্মরণ করতে পারি, যিনি দীর্ঘ তিন দশক তার বিচারবুদ্ধি ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার মাধ্যমে ইংরেজদের খবরদারির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

কৃষক বিদ্রোহ বা প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর আন্দোলনে অনেক দুর্বলতা ছিল—এ কথা স্বীকার করতে হবে। কেননা, শ্রমজীবী পেশার মানুষদের মধ্যে সুগঠিত হয়ে আন্দোলন সফল করার অভিজ্ঞতা সেসব আন্দোলনে ছিল না। কিন্তু শাসকশ্রেণির শোষণ-উৎপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্যেই তারা সংগঠিত হয়ে শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চেয়েছিল। তাই কৃষক বিদ্রোহ বা জাতিসত্তাগুলোর আন্দোলন সফল হয়েছে, নাকি পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটেছে, সেটা মুখ্য বিষয় নয়। সেসব বিদ্রোহ বা আন্দোলনই মূলত ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে স্বদেশ মুক্তির স্বপ্নের ভিত গড়ে দিয়েছিল—এ কথা আমাদের মানতে হবে।

সময়ের আবর্তে গারো পাহাড়ের সোমেশ্বরী, লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা কর্ণফুলী, উত্তরবঙ্গের আত্রাই, ইছামতী ও করতোয়া নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। পাহাড়-সমতল, সবখানেই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো বৈষম্যের শিকার।

যে সাঁওতাল বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের ভিত একসময় নড়ে উঠেছিল, সেই সাঁওতালদেরই কিনা এখনো হোটেলে আলাদা থালায় খেতে দেওয়া হয়! এ কোন শিক্ষায় দীক্ষিত হচ্ছে এ দেশের মানুষ! একজন সাঁওতাল শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে যখন প্রশ্ন ওঠে না—সে জাতিতে সাঁওতাল কি না! কিন্তু হোটেলে খেতে বসলে একজন বাঙালির কাছে সেই শিক্ষক কেন অস্পৃশ্য হয়ে যাবেন?

এ দৃশ্য রাজশাহী অঞ্চলে বিশেষত তানোরে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। কিন্তু প্রশাসন এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সেটা আমাদের জানা নেই। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’

আজ যাঁরা নিজেদের সভ্য ভাবছেন, তাঁরাই একসময় সাঁওতালদের কাছ থেকে স্বাধীনতাসংগ্রামের লড়াইয়ের শিক্ষা নিয়েছিল। এ সাঁওতালেরাই বুকের রক্ত দিয়ে ৩০ জুন নিজেদের জন্য স্বাধীন ভূমির দাবি তুলেছিল। তাঁদের সেদিনের বিদ্রোহই এ উপমহাদেশে স্বাধীনতার স্বপ্নের পথ চিনিয়েছিল। তাই বর্তমান প্রজন্মকে এ গৌরবময় অতীতকে মনে ধারণ করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম বা হুল চালিয়ে যেতে হবে।

  • ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ই–মেইল: [email protected]