শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘চর দখল’ ও শিক্ষক লাঞ্ছনা বন্ধ হোক

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে, তাকে সর্বস্তরের মানুষ স্বাগত জানিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময়ে জনগণের ওপর চেপে থাকা স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে, সুবর্ণ সুযোগ এসেছে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার।

ইতিমধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করার পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি জনমনে আশার সঞ্চার করেছে।

কিন্তু আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুল ও কলেজের শিক্ষক পদাধিকারীদের চাপ সৃষ্টি করে পদত্যাগে বাধ্য করছে। তাঁদের মধ্যে উপাচার্য, অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি আছেন সাধারণ শিক্ষকও।

আরও পড়ুন

এই স্বার্থান্বেষী মহল শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করার পাশাপাশি তাঁদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করছে, কোনো কোনো শিক্ষক সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি নারী শিক্ষকও আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি। বিচলিত হওয়ার বিষয় হলো, স্বার্থান্বেষী মহল তাদের এই হীন স্বার্থ উদ্ধার করতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষকেরা জাতি গঠনের কারিগর। তাঁদের ওপর এই হামলার ঘটনাগুলোতে আমরা ভীষণ ব্যথিত, লজ্জিত বোধ করছি।

আমরা বিশ্বাস করি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো নেতা-কর্মী, যাঁদের সাহসী ও দৃষ্টান্তরহিত গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসকের পতন হয়েছে, তাঁদের কেউ শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো অপকর্মে লিপ্ত হতে পারেন না।

তাহলে কারা এই একের পর এক শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটিয়ে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করছে? আমরা বিশ্বাস করি, এই ঘটনা তারাই ঘটাচ্ছে, যারা চায় না শিক্ষাঙ্গনে স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। কেউ কেউ নিগৃহীতও হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু শিক্ষকেরাও রয়েছেন। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ছাত্র ঐক্য পরিষদের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, ৪৯ জন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। 

এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বারবার আবেদন ও আহ্বান জানানো সত্ত্বেও শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা বন্ধ হয়নি। গত শনিবার তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেছেন, ‘চর দখলের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকেরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হচ্ছেন।’

শিক্ষকদের প্রতি এই অপমান ও লাঞ্ছনা জাতির জন্য চরম লজ্জাজনক। আমরা এই বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানাব, তারা যেন শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক লাঞ্ছনার কর্মকাণ্ড বন্ধে কার্যকর ও টেকসই ভূমিকা নেয়। শিক্ষকদের প্রতি এ রকম লাঞ্ছনা ও নিগ্রহ চলতে থাকলে জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের দরবারে মুখ দেখাতে পারব না।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় বিবেচনায় স্বেচ্ছাচারী কায়দায় নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি হয়েছে। অনেক মেধাবী শিক্ষককে পেছনে ফেলে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের পদোন্নতির দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি হয়েছে। এসব কারণে শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে বঞ্চনাবোধ ও ক্ষোভ জন্ম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু একটি অন্যায়ের প্রতিকার তো আরেকটি অন্যায় দিয়ে হতে পারে না। আইনি পথেই এর প্রতিকার খুঁজতে হবে। এখানে গায়ের জোর দেখানোর সুযোগ আছে বলে মনে করি না।

 এ বিষয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তিনি যেন শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক লাঞ্ছনা বন্ধ করতে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃত্ব সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে যেই আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে, তা আমরা ম্লান হতে দিতে পারি না। অতএব, অবিলম্বে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ‘চর দখলের লড়াই’ বন্ধ করা হোক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাম্যের, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর এবং মূঢ়তার বিরুদ্ধে যুক্তির পথে চলার সংগ্রাম জারি থাকুক। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; আবুল কাসেম ফজলুল হক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; রাশেদা কে চৌধূরী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক; সোহরাব হাসান যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো