পাটিগণিত চ্যাপ্টারে যত চৌবাচ্চা আছে, তার সবগুলোতে কেন একটা-দুটো ফুটো থাকতেই হবে? ‘ইশকুলবেলায়’ অঙ্কে কাচা ছোট মাথায় এই বড় প্রশ্নটা সব সময় খোঁচাত। ভাবতাম, আচ্ছা ভালো কথা, ফুটো যদি থাকলই, সেই ফুটো বন্ধ না করে আহাম্মকের মতো পানি ঢালার দরকারটা কী? যদ্দুর মনে পড়ে সেখানে এ রকম লেখা থাকত: ‘একটি চৌবাচ্চায় ৫০ লিটার পানি ধরে। তাতে দুটো ফুটো আছে। একটি ফুটো দিয়ে মিনিটে দুই লিটার পানি বের হয়ে যায়, আরেকটি দিয়ে মিনিটে তিন লিটার বের হয়ে যায়; মিনিটে ওই চৌবাচ্চায় বালতি দিয়ে ১০ লিটার পানি ঢাললে কতক্ষণে তা ভর্তি হবে?’
চিন্তা করেন কী ভয়ানক সমস্যা! এক দিকে বালতি দিয়ে পানি ঢালা হচ্ছে, অন্য দিক দিয়ে দুই ফুটো দিয়ে পানি বের হয়ে যাচ্ছে। অতি দুর্বোধ্য সেই পানি ঢালাঢালি বিষয়ক অঙ্ক করার সময় ভাবতাম ফুটো বন্ধ না করে পানি ঢালতে যাব কোন দুঃখে?
অঙ্কের শিবেন স্যারকে তা বললে বলতেন, ‘ফুটো বন্ধ করা যাবে না। এভাবেই পানি ঢালতে হবে। তোর কাজ অঙ্ক করা, তুই অঙ্ক করবি।’ আমি সেই অঙ্ক না পারার কারণে ‘বঙ্কুরাম অঙ্ক কষে পারে নাকো হায়/শপাং শপাং বেত তার লাগি খায়’ কায়দায় বেতের বাড়ি খেতাম।
হাইস্কুল পর্ব শেষ হওয়ার পর হাফ ছেড়েছিলাম, ‘যাক বাবা বাঁচা গেছে! অন্তত ফুটোওয়ালা চৌবাচ্চার হাত থেকে তো বাঁচা গেল!’
কিন্তু এই ফুটো কপাল এমনই ফুটো যে, বড় হওয়ার পরও সেই ফুটো চৌবাচ্চার অঙ্ক থেকে আসান পেলাম না। এখন খবরের কাগজ খুলে এক বছরে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার কিংবা খিচুড়ি রান্না শিখতে কোটি টাকা খরচার খবর হররোজ দেখে সেই ফুটো চৌবাচ্চার চিত্রকল্প চোখে ভাসে। কল্পনায় যে চৌবাচ্চার ছবি আসে তাতে ফুটো একটা দুটো না, হাজার হাজার। চারদিকে ঝাঝর টাইপের কী একটা ‘চৌবাচ্চাবস্থা!’
কোভিডের কারণে অনেকের হাতে আগেই বদনা উঠেছে। এখন তেলের দাম এক লাফে ছাদে ওঠায় জিনিসপত্রের দাম চাঁদে উঠে বসেছে। ডলারে টান পড়ায় তেল পাওয়া যাচ্ছে না; তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাকা ঘুরছে না। তাই পূর্ণিমার রাতেও ঘরে ঘরে ঘণ্টায় ঘণ্টায় অমাবস্যা। চালের বাজারে আগুন। পকেটে ছুঁচোর কেত্তন। আট ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে পাবলিকের হাতে বদনার জায়গায় হারিকেন উঠেছে।
খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, আগামী বছর বিশ্ব দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। বাংলাদেশ যাতে সেই দুর্ভিক্ষের শিকার না হয় সে জন্য তিনি খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রতি ইঞ্চি জমি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের নিজেদের ভূমিকায় নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করে নিজেদের সঞ্চয় করে এবং কৃচ্ছ্র সাধন করে চলতে হবে। আমরা আশা করি সবাই সেভাবে চলবেন।.... সরকার কোনো কিছুই অপ্রয়োজনে ব্যবহার করতে যাবে না। আমরা যা প্রয়োজন তা ব্যবহার করব। এর বেশি নয়। আমাদের অপ্রয়োজনীয় কোনো কিছু ব্যবহারের সুযোগ নেই।’
অর্থাৎ তিনি সবাইকে, বিশেষ করে সরকারি লোকজনকে ‘আজুরিয়া’ খরচ বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার নামক চৌবাচ্চার ফুটো বন্ধ করতে বলেছেন যাতে সরকারি অর্থ নামক পানি (যার অপর নাম জীবন) বেরিয়ে যেতে না পারে।
কিন্তু আমাদের আমলারা সবাই একেকজন শিবেন স্যার হয়ে বসে আছেন। তাঁরা যেন বলছেন, ‘পানি পড়ে পড়ুক। চৌবাচ্চা খালি হয় হোক। ফুটো বন্ধ করা যাবে না। লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন।’
সেই অসংখ্য ফুটোর মধ্যে একটি ফুটোর কথা প্রথম আলোর খবরে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় দেশের মানুষের যখন দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাচ্ছে, সেই মুহূর্তে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের জন্য ৪৩ কোটি টাকা খরচ করে বাসভবন করছে সরকার।
বাসভবন না বলে এটিকে রাজপ্রাসাদ বলা ভালো। ইস্কাটন গার্ডেন এলাকায় পাশাপাশি নির্মিত হবে দুটি প্রাসাদ। প্রতিটি ভবন হবে তিন তলা। সাড়ে ১৮ হাজার বর্গফুটের। প্রতিটি ভবনে ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা খরচ করে দুই সেট সুইমিং পুল বানানো হবে। একটি পরিবারে কতজন ‘জলকেলিসক্ষম’ সদস্য থাকলে দুই সেট সুইমিং পুল রাখার কথা ইঞ্জিনিয়ারদের মাথায় আসে তাও আলাদা করে বসে অঙ্ক করে বের করার মতো বিষয়। এই প্রাসাদের ভেতরের ভাবসাবে (ভালো বাংলায় যাকে বলে ‘অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা’) খরচ হবে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। দুটি ভবনে খাট পালঙ্ক-চেয়ার টেবিলের পেছনে খরচ হবে দেড় কোটি টাকা। ২টি ভবনের জন্য ৭টি করে মোট ১৪টি এলইডি টেলিভিশন কেনা হবে। এতে ব্যয় হবে ৯ লাখ টাকা। এত টেলিভিশন কারা দেখবেন—সেও মানবেতিহাসের এক বিভৎসতম বিস্ময়কর প্রশ্ন।
এই রাজ রাজড়া ঘরানার প্রকল্পটি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী জিনিসটা পাশ করলেই আইনের মতো নিজস্ব গতিতে এই কাজ দৌড়তে শুরু করবে।
সিসিটিভি সিস্টেম কেনা হবে ৩২ টি। তাতে খরচ হবে ৬০ লাখ টাকা। ঘরে আগুন ধরলে তা নেভানোর যন্ত্রপাতি কিনতে লাগবে পৌনে দুই কোটি টাকা। মাত্র তিন তলার ভবনে উঠতে এক হাজার কেজি লিফটে (ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড) খরচ ধরা হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আমরা যারা প্রতিদিন পাঁচ তলা-ছয় তলা সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করি তাদের কাছে অবশ্য এর তাৎপর্য ধরা পড়ার কথা না। রোমান্টিক রেইনি সিজনে বৃষ্টি নামলে সেই ন্যাচারাল বৃষ্টির পানি দিয়ে যাতে অজু গোসল করা যায় তার জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হবে। এত খরচ হবে ১৮ লাখ টাকা। এই রকমের একটা এলাহী কারবার সেখানে হতে যাচ্ছে।
এই রাজ রাজড়া ঘরানার প্রকল্পটি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পরিকল্পনামন্ত্রী জিনিসটা পাশ করলেই আইনের মতো নিজস্ব গতিতে এই কাজ দৌড়তে শুরু করবে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশবাসী যখন দৌড়ের ওপর আছে, প্রধানমন্ত্রী যখন নিজে সবাইকে খরচের বিষয়ে সাবধান হতে বলছেন, তখন এই খবর পড়ছি। পড়ছি আর ভাবছি, আমরা সরকারি চৌবাচ্চায় আমাদের শ্রমে-ঘামে রক্ত পানি করা টাকারূপী পানি ঢালছি। ‘বটমলেস বাস্কেট’-এর মতো অসংখ্য ফুটো দিয়ে তা গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। শিবেন স্যাররা বলছেন, ‘পানি পড়ে পড়ুক। ফুটো বন্ধ করা যাবে না।’
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]