ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি হত্যার সাম্প্রতিক এ ঘটনার দায় শুধু হামাস ও নেতানিয়াহু সরকারের নয়, রক্তের দাগ পশ্চিমাদের হাতেও লেগে রয়েছে।
হ্যাঁ, এটা সত্যি যে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকার সন্নিকটে ইসরায়েলি বসতিতে হামলা চালিয়েছেন। কিন্তু এ হামলা নির্দিষ্ট কোনো জায়গা থেকে শুরু হয়নি, কিংবা আগে থেকে সতর্কতাও ছিল না। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা কোনো প্ররোচনা দেয়নি। কিন্তু সেটা আমরা কেউই বিশ্বাস করি না।
পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারগুলো ভালো করেই জানে, গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রকৃতপক্ষে কতটা প্ররোচিত করা হয়েছে। কেননা এসব সরকার দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে আসছে, তাতে সমর্থন দিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনিদের তাদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়ন এবং বাকি যাঁরা আছেন, তাঁদের বসতিতে বন্দী করে রাখার ঘটনায় পশ্চিমা সরকারগুলো সমর্থন দিয়ে আসছে।
গত ১৬ বছরে ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমাদের পৃষ্ঠপোষকতা একবারও দোদুল্যমান হয়নি। এমনকি গাজার পশ্চিমাঞ্চলের ছিটমহলকে ইসরায়েল খোলা আকাশের নিচে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কারাগার থেকে ভয়ংকর নির্যাতনের শিবিরে পরিণত করার পরও তাদের সেই সমর্থনে একবিন্দু্ও চিড় ধরেনি।
রেশন করে ফিলিস্তিনিদের খাবার ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি দেওয়া হয়। জীবনের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনগুলো মেটাতে দেওয়া হয় না। ধীরে ধীরে তাঁদের সুপেয় পানির উৎস বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার উপকরণ ও ওষুধপত্র পৌঁছাতে বাধা দেওয়া হয়।
ফলে এটি কোনোভাবেই অজ্ঞানতাজনিত সমস্যা নয়। ইসরায়েলের এসব অপরাধ সম্পর্কে ঠিক সময়েই জানতে পেরেছে পশ্চিমা সরকারগুলো। নিজেদের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের গোপন তারবার্তায় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অসংখ্য প্রতিবেদনে তারা জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্র ইসরায়েলের অপরাধের কথা জেনে আসছে।
এখন পর্যন্ত পশ্চিমা রাজনীতিবিদেরা ইসরায়েলিদের আগ্রাসন বন্ধে কিছুই করেননি। কোনো অর্থপূর্ণ চাপ তাঁরা দেননি। উল্টো তাঁরা ইসরায়েলকে অবারিতভাবে সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন।
‘মানবরূপী পশু’
গাজায় এখন যে বর্বর আচরণ ইসরায়েল শুরু করেছে, তার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব কম দায়ী নয়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট খাদ্য ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি বন্ধ করে দিয়ে ইসরায়েলে সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ।
ছিটমহলে খাঁচার মতো আবাসনে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি পুরুষ-নারী-শিশুদের তিনি ‘মানুষরূপী পশু’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু ইতিহাস বারবার সাক্ষী দিচ্ছে, মানুষের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হলে তার পরিণতি কত ভয়াবহ হয়।
পশ্চিমারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন যে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটা ‘দীর্ঘ যুদ্ধ’ সামনে। দীর্ঘ যুদ্ধ ওয়াশিংটনের কাছে সব সময়ের জন্য আদরণীয়। কেননা দীর্ঘ যুদ্ধ তাদের সমরাস্ত্র শিল্পের জন্য এবং অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে জনসাধারণের চোখ সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আশীর্বাদ হিসেবে প্রমাণিত।
মার্কিন বিমানবাহী রণতরি এখন ফিলিস্তিনের উপকূলের পথে। ইসরায়েলকে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা পাঠাচ্ছে ওয়াশিংটন। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের হত্যায় সেগুলো ব্যবহার করা হবে। ইসরায়েলি সেনাদের জন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর প্রস্তুতিও চলছে।
ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে স্থল আগ্রাসনে ইসরায়েলি সেনারা এসব অস্ত্র ব্যবহার করবেন।
আর অবশ্যই ইসরায়েলের জন্য অঢেল অর্থ দেওয়া হবে। এখন বছরে ইসরায়েলকে যে চার বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়, নিশ্চিতভাবেই তার চেয়ে বেশি হবে। ওয়াশিংটনের পাঠানো সেই অর্থ স্বঘোষিত ফ্যাসিস্ট ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদী ইসরায়েলি সরকার খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট ভূখণ্ডটুকুও নিজেদের দখলে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যয় করছে। ওয়াশিংটনের সবুজসংকেত পাওয়ামাত্রই ইসরায়েল বাকি ভূখণ্ডটুকুও দখলে নিতে নেমে পড়বে।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক অবশ্য বাইডেনকে ছাপিয়ে যেতে চাননি। কিন্তু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে ইসরায়েলের একটি বিশাল পতাকা ওড়ানো হয়েছে। গাজার খাঁচায় বন্দী বাসিন্দাদের ওপর সম্ভবত বোমা ফেলতে সহযোগিতা করার জন্য তিনি ‘সামরিক ও গোয়েন্দা’ সহযোগিতা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।
নীরবে সব অত্যাচার সয়ে যেতে হবে
সত্য হচ্ছে, আজকে যে মহাবিপর্যয়, সেটা পশ্চিমা শক্তির উদাসীনতা, পক্ষপাতিত্ব ও বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনি জনসাধারণের বিরুদ্ধে চালানো ইসরায়েলি নৃশংসতার পক্ষে কূটনৈতিক বর্ম গড়ে তোলার বিষয়টি রয়েছে।
পশ্চিমাদের এই অকৃপণ সমর্থন এবং পশ্চিমা গণমাধ্যমে বসতি স্থাপনকারীদের ফিলিস্তিনিদের ভূমি চুরি এবং ইসরায়েলি সেনাদের নিপীড়নকে ‘মানবিক সংকট’ বলে চালিয়ে দেওয়ার যে রেওয়াজ, তার জন্য ইসরায়েলিরা সব সময় অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন।
ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটা প্রকৃত বন্দোবস্তে আসা প্রয়োজন। সেটা অবশ্যই ধাপ্পাবাজির অসলো চুক্তি ধরে নয়। কেননা, সেই চুক্তিতে ‘ভালো’ ফিলিস্তিনি নেতৃত্বকে ফাঁদে ফেলে তাদের নিজেদের জনগণের অধীনতাকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে।
ইসরায়েলকে অবশ্যই আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে একটা সত্যিকারের স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে আনতে বাধ্য করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি প্যাক আমেরিকানা (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার নেতৃত্বে করা শান্তিচুক্তি) মেনে নিতে বাধ্য করতে চোখরাঙানি দেওয়া বন্ধ করাতে হবে।
ফিলিস্তিনিরা নীরবে তাঁদের সব দুর্ভোগ সহ্য করে যাবেন, সেটাই পশ্চিমারা প্রত্যাশা করে। এর কারণ হলো, ফিলিস্তিনিরা যখন চিৎকার করেন, তখন পশ্চিমা দেশগুলোর জনসাধারণের সামনে এটা খোলাসা হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয় যে পশ্চিমা নেতাদের বলা ‘নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা’ আসলে কতটা ধাপ্পাবাজি।
গাজায় রক্তের প্লাবন
পশ্চিমা নেতারা সবকিছুই দেখছেন। তাঁরা দেখছেন যে ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষদের (যাদের অর্ধেকই শিশু) অভুক্ত রাখা হচ্ছে, তাদের পানি পান করতে দেওয়া হচ্ছে না, বিদ্যুৎ-জ্বালানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যথাযথ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং তাদের ওপর ক্রমাগত বোমা হামলা করা হচ্ছে।
পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যম প্রত্যাশা করে, গাজার নির্যাতন শিবিরে ফিলিস্তিনিরা ঠোঁট কামড়ে পড়ে থেকে সব নির্যাতন সহ্য করে যাবেন, যাতে করে পশ্চিমা জনগণের বিবেকে কোনো ধরনের টোকা না লাগে।
গাজা থেকে তার জনগোষ্ঠীর শেষ অস্তিত্বটুকু ধীরে ধীরে মুছে ফেলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা এ কাজে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। গাজার জনসাধারণের রক্তে তাদের হাত আরেকবার প্লাবিত হলো।
জনাথন কুক ইসরায়েলি-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে তিনটি বইয়ের লেখক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত