শেখ হাসিনার পতনের আগে আমার বন্ধুরা প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করত, আমি কেন কারাগারের বাইরে! আমার উত্তর ছিল, কারাগারেই তো আছি, শুধু পার্থক্য হলো আমি চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ নই। এক দশক ধরে, রূপক অর্থে, জাতি হিসেবে আমরা একটা কারাগারের মধ্যেই ছিলাম। আমি ও আমার পরিবারের অনেকের ছিল অনেকটা ‘বন্দীর’ দশা। বহু বঞ্চনা, বিধিনিষেধ, হয়রানি ও হুমকির মধ্যেই আমরা এই সময় পার করেছি।
আমার প্রতি বঞ্চনা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের প্রথম থেকে। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাকে কুমিল্লা বার্ড-এর (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি) ‘বোর্ড অব গভর্নরস’-এর সদস্য করা হয়। তবে নতুন সরকার এসেই ২০০১ সালে আমাকে বাদ দিয়ে দেয়।
এর পরেরটি ছিল পারিবারিক বঞ্চনা। আমার বড় ছেলে, মাহবুব মজুমদার। সে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি থেকে স্নাতক, স্টানফোর্ড থেকে স্নাতকোত্তর, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকস ও থিওরিটিক্যাল ফিজিকসে পিএইচডি ডিগ্রি এবং ইম্পিরিয়াল কলেজ থেকে পোস্ট-ডক্টরাল সম্পন্ন করে। এরপর বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে কাজ করার জন্য দেশে ফিরে আসে। এ ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়।
এরপর শুরু হয় আমার বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ। ২০০২ সালে নাগরিক সংগঠন হিসেবে ‘সুজন’ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এবং আমি নির্বাচনপ্রক্রিয়া পরিচ্ছন্ন করা এবং সমাজের নানা অসংগতি নিয়ে ছিলাম অত্যন্ত সোচ্চার কণ্ঠ। আমাদের তখন বলা হতো আমরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের আমলে আমরা আখ্যায়িত হই বিএনপি হিসেবে।
এই অভিযোগ অব্যাহত থাকে, বিশেষ করে ওবায়দুল কাদেরের মুখ থেকে, আওয়ামী লীগের পতনের দিন পর্যন্ত। এই অভিযোগ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে শুনেছি, আমি ও আমার মতো আরও চার সোচ্চার কণ্ঠকে থামাতে সরকারের বিশেষ বাহিনী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। তাই ৫ আগস্ট হাসিনার পতন না হলে আমাদের অস্তিত্বই হয়তো বিপন্ন হতো।
আমি শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে তাঁর চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছি ধাপে ধাপে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমার ওপর প্রথম বড় ধাক্কা আসে ২০১৩ সালের বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী এবং সিলেটের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়। সেই নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে আমরা সুজনের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম। আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থীদের সবাই ছিলেন বিদায়ী মেয়র।
আমরা দেখিয়েছিলাম যে তাঁদের আয়, সম্পদ ও দায়দেনা, বিরোধী বিএনপির প্রার্থীদের তুলনায় ছিল আকাশচুম্বী। সংবাদ সম্মেলনের পর সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল ক্ষমতার সঙ্গে জাদুর কাঠি জড়িত। এরপর ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় যে আমরা বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে তাদের মেয়র প্রার্থীদের সম্পর্কে মিথ্যাচার করেছি। আমাদের সব তথ্য ছিল নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা থেকে নেওয়া। এরপরও পরবর্তী সব নির্বাচনের অসংগতিগুলো আমরা তুলে ধরি। বিভিন্নভাবে হুমকিরও সম্মুখীন হই।
গত বছর থেকে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ ও এনএসআই আমাদের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্নভাবে তদন্ত শুরু করে, যা সম্ভবত এখনো চলছে। এ ব্যাপারে এনবিআরও বসে নেই। দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের সব অর্থকড়ি ছাড় বন্ধ করে দেয় এনজিও ব্যুরো। এ ছাড়া যখনই দেশের বাইরে গিয়েছি, তখনই এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন আমাকে বসিয়ে রেখেছে। আর ৫ সেপ্টেম্বর একটি কনফারেন্সে ব্যাংকক রওনা হই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়ার আগপর্যন্ত এয়ারপোর্টে আমাকে বসিয়ে রাখা হয়।
এরপর আসে ২০১৮-এর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে আগে ৪ আগস্ট ২০১৮ তারিখে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে জড়িত ছাত্র-তরুণেরা পুলিশ ও হেলমেট বাহিনীর যৌথ আক্রমণে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। বিখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলম গ্রেপ্তার হন। সেদিন সন্ধ্যায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বিদায়ী নৈশভোজে আমার বাসায় আসেন। সেখান থেকে ফেরার সময় ক্ষমতাসীনদের মাস্তানদের দ্বারা আক্রান্ত হয় তাঁর গাড়িবহর। আমার বাসাও আক্রমণের শিকার হয়। আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশি কূটনীতিকদের এবং স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া।
আক্রমণ চলাকালে আমরা ৯৯৯-এ টেলিফোন করি। আক্রমণ শেষ হওয়ার পর পুলিশ আসে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কথা না বলেই চলে যায়। পরদিন থানায় গেলে পুলিশ এমনকি আমাদের মামলাও নিতে চায়নি। কয়েক দিন পর তারা আমাদের দেওয়া অভিযোগকে মামলায় পরিণত করে। পুলিশ মামলার চার্জশিটে দাবি করে যে আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নিয়ে আমার বাসায় ষড়যন্ত্র করছিলাম।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত সরকার আমার পরিবারের ওপর আরেকটি বড় অন্যায় করে। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি উত্তরবঙ্গের একটি জেলায় নিজেদের জমিতে স্থানীয় দরিদ্র মানুষের জন্য হাসপাতাল নির্মাণের জন্য অসিয়ত করে যান। এই জমির ওপর দিয়ে হাইওয়ে নির্মাণ করা হয়। এরপর এ জমির ওপর দিয়ে তিনটি বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করা হয়। গত বছর একই জমির ওপর দিয়ে সরকার পুলিশ এনে জোর করে আরও দুটি ১৩২ কেভির হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনের উদ্যোগ নেয়।
গত বছর থেকে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ ও এনএসআই আমাদের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্নভাবে তদন্ত শুরু করে, যা সম্ভবত এখনো চলছে। এ ব্যাপারে এনবিআরও বসে নেই। দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের সব অর্থকড়ি ছাড় বন্ধ করে দেয় এনজিও ব্যুরো। এ ছাড়া যখনই দেশের বাইরে গিয়েছি, তখনই এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন আমাকে বসিয়ে রেখেছে। আর ৫ সেপ্টেম্বর একটি কনফারেন্সে ব্যাংকক রওনা হই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়ার আগপর্যন্ত এয়ারপোর্টে আমাকে বসিয়ে রাখা হয়।
এসব কারণে, স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, দু-দুবার স্বৈরাচারের (১৯৯০ ও ২০২৪) পতন ঘটলেও তাদের সৃষ্ট কালাকানুন এখনো আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সুতরাং একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হলে বিদ্যমান স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো ভাঙতে হবে।
● বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)