বিশ্লেষণ
মোদি কি এবার হেরে যেতে পারেন
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় দফার ভোটগ্রহণ আজ ৭ মে। ইতিমধ্যে দুই দফার ভোটের পর ভোটারদের যে মনোভাব ও পারিপার্শ্বিক চিত্র দেখা যাচ্ছে, তা ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যসহ দলটির আচরণে তেমনটিই প্রতীয়মান হচ্ছে। তাহলে কি বিজেপিকে ক্ষমতা হারানোর ভয় পেয়ে বসেছে? কী কী কারণ মোদির হেরে যাওয়ার আশঙ্কাকে বাস্তবসম্মত করে তুলেছে, তা বিশ্লেষণ করছেন দেশটির বিরোধী দল কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা শশী থারুর
ভারতের নির্বাচন নিয়ে কিছুদিন আগেও ব্যাপকভাবে যে ধারণা ছিল, নির্বাচন দ্বিতীয় মাসে গড়াতে না গড়াতে সেই ধারণা ভেঙে পড়েছে।
আত্মতুষ্টিতে বুঁদ হয়ে থাকা পণ্ডিতেরা অনেক আগেই রায় দিয়ে রেখেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অতি স্বাচ্ছন্দ্যে জিতে যাবে। কিন্তু সাত ধাপের নির্বাচনের মধ্যে দুটি ধাপের প্রায় ১৯০টি আসনের ভোট গ্রহণের পর মনে হচ্ছে, বিজেপির হাতে জয় যতটা সহজে ধরা দেবে বলে ভাবা হচ্ছিল, সেটি ততটা সহজে বোধ হয় আর হচ্ছে না।
ভারতের স্বায়ত্তশাসিত নির্বাচন কমিশন (ইসি) সাতটি ধাপের সব কটি আসনে ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো ধরনের আগাম জরিপের ফল প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। (আগামী ১ জুন ভোট গ্রহণ শেষ হবে এবং ৪ জুন ফলাফল ঘোষণা করা হবে)।
তবে ভোটারদের মনোভাব ও গতিপ্রকৃতির অনানুষ্ঠানিক পর্যবেক্ষণ যে জোরালো ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা মোটেও বিজেপির পক্ষে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, বিজেপিকে তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আনার পক্ষে দলটি ভোটারদের তেমন কোনো জুতসই যুক্তি দেখাতে পারেনি।
মোদি নতুন চাকরির বাজার সৃষ্টি করবেন বলে জনগণকে যে কথা দিয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এলে তিনি পূরণ করতে পারবেন—এমন আশা থেকে ২০১৪ সালের পর ২০১৯ সালেও যাঁরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের আবার মোদিকে ভোট দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
সত্যিটা হলো, মোদির আমলে বেকারত্ব তো কমেইনি; বরং তা মারাত্মকভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে। সম্প্রতি বেকারত্বের পারদ কিছুটা পড়তির দিকে বলে মনে হলেও এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে সরকারি খাতাপত্রে বেকারত্বের যে হিসাব দেখানো হচ্ছে, আদতে তা তার চেয়ে অনেক বেশি।
প্রকৃত অবস্থা হলো, ২০১৪ সাল থেকে ভারতের ৮০ শতাংশ লোকের আয় কমতির দিকে রয়েছে। এসব লোকের জিনিসপত্র কেনার ক্ষমতা এবং সঞ্চয় করার ক্ষমতা দুটিই ধসে গেছে। অনেকেই জনকল্যাণকে ঠিকমতো সুরক্ষা দিতে না পারার জন্য সরকারকে দায়ী করে আসছেন। কিন্তু তারপরও নিশ্চিতভাবে মোদি তাঁর ব্যক্তিগত ইমেজ দিয়ে কট্টর ভক্তদের নিয়ে যে গোষ্ঠীকে দাঁড় করিয়েছেন, তাদের সুবাদে তিনি এখনো যথেষ্ট জনপ্রিয়তা উপভোগ করছেন।
মোদির আচরণ ও হাবভাবে তাঁর ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি তাঁর মুসলিমবিরোধী হাঁকডাক থেকে বেরিয়ে এখন সরাসরি আক্রমণের দিকে চলে গেছেন। গত মাসে একটি নির্বাচনী প্রচারণা সভায় মোদি কোনো রকম রাখঢাক না করেই বলেছেন, কংগ্রেস পার্টি সরকার গঠন করলে সেই সরকার হিন্দুদের জমিজমা, সহায়-সম্পত্তি সবকিছু মুসলমানদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেবে। মোদি মুসলমানদের ভারতীয় না বলে ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা পয়দা করা লোক’ বলে অপমান করেছেন।
ব্যক্তি মোদির জনপ্রিয়তায় ভাটা না পড়লেও তাঁর দলের প্রার্থীরা ততটা জনপ্রিয় নন। বিজেপির প্রার্থীরা ভোটারদের সরাসরি অবজ্ঞার মুখে না পড়লেও একধরনের প্রচ্ছন্ন উদাসীনতার মুখে যে পড়ছেন, তাতে সন্দেহ নেই।
মোদির আচরণ ও হাবভাবে তাঁর ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি তাঁর মুসলিমবিরোধী হাঁকডাক থেকে বেরিয়ে এখন সরাসরি আক্রমণের দিকে চলে গেছেন। তিনি বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টিকে নিশানা করে তোপ দাগতে শুরু করেছেন।
মোদি বলেছেন, কংগ্রেস পার্টির ইশতেহারে ‘মুসলিম লিগের সিল লাগানো আছে’। গত মাসে একটি নির্বাচনী প্রচারণা সভায় মোদি কোনো রকম রাখঢাক না করেই বলেছেন, কংগ্রেস পার্টি সরকার গঠন করলে সেই সরকার হিন্দুদের জমিজমা, সহায়-সম্পত্তি সবকিছু মুসলমানদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেবে।
কংগ্রেস পার্টির ইশতেহারে না ‘মুসলিম’ না ‘ভাগ-বাঁটোয়ারা’—এ দুটির কোনো একটি শব্দ না থাকার পরও তিনি কংগ্রেস পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানের নির্জলা অপব্যাখ্যা দিয়েছেন। মোদি মুসলমানদের ভারতীয় না বলে ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা পয়দা করা লোক’ বলে অপমান করেছেন।
এ ধরনের চরম উসকানি দেওয়া বক্তৃতা তাঁর পদ-পদবির জন্য অবমাননাকর। একজন প্রধানমন্ত্রীর সারা দেশের সব নাগরিকের সেবক হওয়ার কথা থাকলেও মোদি খুল্লামখুল্লাভাবে ভারতের ২০ কোটি নাগরিককে অবজ্ঞা করেছেন। বিজেপির অন্যান্য নেতাও একই ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। যেমন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, বিজেপি যদি হেরে যায়, তাহলে ভারতে শরিয়াহ আইন চালু হয়ে যাবে।
এ ধরনের উগ্র ও চরমপন্থী বক্তৃতাবাজির পরও সেগুলোকে খুব কমই আশ্চর্যজনক বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, কমবেশি সবাই জানে, ধর্মের ভিত্তিতে ভোটারদের ভাগ করে ফেলার চেষ্টা বিজেপির একটি পরীক্ষিত কৌশল।
তাদের যুক্তিটি খুব সহজ, মুসলমানদের ভয়ংকরভাবে উপস্থাপন করাটা ভারতের মোট হিন্দু জনগোষ্ঠীর (সংখ্যায় যাঁরা ভারতের প্রায় ৮০ শতাংশ) অর্ধেককেও যদি তাদের অন্যান্য পার্থক্য ভুলে বিজেপির শিবিরে একত্র করতে পারে, তাহলে নিশ্চিতভাবে আরেকটি জয় তাদের ঝুলিতে পড়বে।
কিন্তু বিজেপির এই কৌশল যে একেবারে নিশ্চিত লক্ষ্যভেদী, তা কিন্তু নয়। সে কারণে তারা আরও কিছু কৌশল নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই তারা বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তারপর সেসব অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়ার কথা বলে তাঁদের বিজেপির ঘাটে নৌকা বাঁধতে বাধ্য করেছে।
গায়ে দুর্নীতির কালি লাগানো বিরোধী নেতাদের বিজেপির ‘ওয়াশিং মেশিনে’ ঢুকে একেবারে ‘সাফ-সুতরো’ হয়ে বের হওয়াটা এখন জাতীয় কৌতুকে পরিণত হয়েছে। বিকল্প হিসেবে বিজেপি ছোট ছোট দলকে নিয়ে জোট গড়ার প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছে।
অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম পার্টি এসব দলের একটি। বছর কয়েক আগে লোকসভায় তারা মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল এবং দলটির নেতা মোদির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু এখন আচমকা তাদের সব কসুর মাফ করে দেওয়া হয়েছে।
পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ওডিশায় বিজু জনতা দল এবং পশ্চিমের রাজ্য পাঞ্জাবের অকালি দলকে (এ দুটি দলই পূর্ববর্তী জোট গঠনের সময় বিজেপিকে পরিত্যাগ করেছিল) বিজেপির নিজের দিকে টানার চেষ্টা খুব কমই সফল হয়েছে। দুটি দলই বিজেপির অনুরোধ ঠেলে ফেলে দিয়েছে। তবে কোনো দলকে কবজায় নেওয়ার ক্ষেত্রে যখন প্ররোচনা ও সহযোগিতা দেওয়ার লোভ কাজ করে না, তখন বিজেপি সরাসরি ভয় দেখানোর পথে হাঁটে।
দিল্লি ও পাঞ্জাবের বিধানসভা দখলে রাখা আম আদমি পার্টির ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটেছে। দলটির প্রধান ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে রাজি না হওয়ায় একটি মামলায় আসামি বানিয়ে তাঁকে রাতারাতি ধরে নিয়ে গারদে পুরে দেওয়া হয়েছে। কেজরিওয়ালের ডেপুটিকে কোনো রকম অভিযোগ ছাড়াই প্রায় এক বছর কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছে।
কংগ্রেসের সঙ্গেও একই ধরনের আগ্রাসী আচরণ করা হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই দলটির ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়েছে। একটি লুটের মামলার অনুসন্ধান কাজের অংশ হিসেবে গত মাসেই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর হেলিকপ্টারে তল্লাশি চালানো হয়েছে। এগুলো ব্যাপক জনসমর্থনপুষ্ট একটি আত্মবিশ্বাসী দলের কাজ-কারবার হতে পারে না। বরং এসব এমন একটি দলের কাজ, যাদের মনে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার ভয় প্রবলভাবে কাজ করে।
বিজেপি ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে ছয়টি রাজ্যে সব কটি আসনে জিতেছিল। একটি বাদে সব কটি আসনে তাদের জয় হয়েছিল তিনটি রাজ্যে। দুটি বাদে সব কটি আসনে জয় পেয়েছিল দুটি রাজ্যে। এসব রাজ্যে বিজেপির গমনপথ একটাই, আর সেটি হলো—পতন। এসব রাজ্যের প্রতিটিতে যদি বিজেপি হাতে গোনা আসনও হারায়; অর্থাৎ সব মিলিয়ে মাত্র ৩২টি আসন যদি তাদের হাতছাড়া হয়, তাহলেও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে।
আর এমনটি ঘটার জোরালো সম্ভাবনা আসলেই আছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনের মাস কয়েক আগে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ জম্মু–কাশ্মীরে একটি সামরিক বহরে হামলা চালানোর পর সেই ঘটনাকে ভোট টানার ক্ষেত্রে বিজেপি কাজে লাগিয়েছিল।
সেই ঘটনা তখন বিজেপির ভোট বাড়াতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনে ভোটারদের আচ্ছন্ন করার মতো সে ধরনের কোনো ঘটনা নেই। সে কারণে বিজেপি আগেরবারের মতো ফল আশা করতে পারছে না।
এবারকার ভোটে জনসাধারণের সামনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের যথেষ্ট নজির আছে। অন্যদিকে বিরোধীরা নতুন আত্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়েছে। ফলে বাতাসে এখন পরিবর্তনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি, যিনি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং ভারতের পররাষ্ট্র ও মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ