কোন জিনিস কত খারাপ, তা বুঝতে এর তুলনা হয় কম খারাপের সঙ্গে। যেমন আমরা বলি, এই এই স্থানীয় নেতা আগেরজনের চেয়েও বেশি অত্যাচারী, রিজার্ভের অবস্থা আগের চেয়েও শোচনীয়, বন উজাড় হচ্ছে আগের চেয়েও বেশি।
ভারতের মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ আদানি গ্রুপের সঙ্গে সম্পাদিত কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি নিয়ে বিশ্লেষণে এখন তাই করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটি রামপাল চুক্তির চেয়েও বাংলাদেশের জন্য খারাপ একটি চুক্তি।
রামপাল চুক্তি ছিল একটি বিতর্কিত ও সমালোচিত চুক্তি। সুন্দরবনের কাছে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের এই চুক্তিটির সমালোচনা ছিল প্রধানত দুটি কারণে। ১. এর পরিবেশগত ঝুঁকি ২. এতে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে ভারতীয় কোম্পানিকে বিদ্যুৎ সরবরাহের অযৌক্তিক সুবিধা দেওয়া। এখন দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুতের দাম, বিদ্যুৎ ক্রয়ে বাধ্যবাধকতা, ক্যাপাসিটি চার্জ, বিরোধ নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আদানির সঙ্গে গোপনে সম্পাদিত চুক্তি, এমনকি রামপাল চুক্তির চেয়েও খারাপ। সবকিছু মিলিয়ে এই চুক্তিকে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যে পরিমাণ বিদ্যুতের জন্য চরম অস্বাভাবিক মূল্য ও দায় নিয়ে বর্তমান সরকার এই চুক্তিটি করেছে, সেই বিদ্যুতের কোনো প্রয়োজনই নেই বাংলাদেশের। কারণ, বর্তমানে যে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে, তা দেশের বিদ্যুতের মোট চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি।
কিন্তু এই বিদ্যুৎ সঞ্চালনা অর্থাৎ তা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করার অবকাঠামো বাংলাদেশে নেই। এই অবকাঠামো নির্মিত হলে আদানির প্রকল্পটি বাদেই বাংলাদেশের বিদ্যুতের বর্তমান ও অদূর ভবিষ্যতের চাহিদা পুরোপুরিভাবে মেটানো সম্ভব। এরপরও বাংলাদেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় এই চুক্তিটি কেন আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে বিস্মিত হচ্ছেন দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই চুক্তির দায় আসলে কার এবং কতটা জবাবদিহিহীন পরিস্থিতি থাকলে একটি সরকার এ ধরনের চুক্তি করার দিকে অগ্রসর হতে পারে? এ চুক্তি এবং এ ধরনের চুক্তির ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসার উপায় খুঁজতে হলে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
ওয়াশিংটন পোস্ট, ডেইলি স্টারসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেভাবে মূল্যায়িত করা হচ্ছে, তাতে এটি স্পষ্ট যে এই চুক্তিটি করা হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থকে উপেক্ষা করে আদানি গ্রুপকে বিপুল আর্থিক মুনাফা প্রদান করার জন্য এবং এতে বাংলাদেশের জ্বালানি–নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার হবে।
আদানির সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে গণমাধ্যমগুলো থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি বা কথা বলতে রাজি হননি। চুক্তিটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সম্পাদন করেছিল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী না। বুঝতেই পারছেন এখন সময়টা ঝুঁকিপূর্ণ!’
২.
দেশ-বিদেশের সংবামাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে আদানির সঙ্গে চুক্তির বহু বৈষম্য ও অযৌক্তিক দিক উন্মোচিত হয়েছে। এর সামান্য কিছু চুম্বক অংশ বর্ণনা করলেই আমরা এটি বুঝতে পারব।
প্রথমত, এই চুক্তি করা হয়েছে আদানি পাওয়ারের উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটা ২৫ বছরে জন্য কেনার ‘শর্তহীন ও অপরিবর্তনীয়’ নিশ্চয়তা দিয়ে। ফলে আদানির কোম্পানি এই চুক্তির কোনো ধারা না মানলেও বাংলাদেশ চুক্তিটি বাতিল করতে পারবে না, শুধু চুক্তি ভঙ্গের প্রতিকার খোঁজার সুযোগ দেবে আদানিকে।
দ্বিতীয়ত, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির স্থায়ী ও পরিবর্তনশীল (যেমন কয়লার দাম, বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামত ইত্যাদি) খরচগুলোর বিনিয়োগ ঝুঁকির প্রায় সবকিছু একতরফাভাবে বাংলাদেশকে বহন করতে হবে, আদানি পাওয়ারের ঝুঁকি এখানে নামমাত্র।
তৃতীয়ত, পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার দাম নির্ধারণ পদ্ধতি এমনভাবে রাখা হয়েছে, যাতে আদানি গ্রুপ কম মূল্যে কয়লার সংস্থান করতে পারলেও এর জন্য বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি মূল্য আদায় করতে পারবে। চতুর্থত, বাংলাদেশে যদি আদানির বিদ্যুতের কোনো প্রয়োজন বর্তমানে বা ভবিষ্যতে না-ও থাকে, তবু তাদের উৎপাদিত বিদ্যুতের অন্তত ৩৪ শতাংশ বাংলাদেশকে কিনতেই হবে। একই সঙ্গে পরিশোধ করতে হবে কয়লা সরবরাহকারী, পরিবহনকারী ও বন্দর অপারেটরদের সব জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ, যার অধিকাংশের মালিক আবার আদানি নিজেই।
এখানেই শেষ নয়। এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশকে আগামী ২৫ বছরের জন্য আদানি পাওয়ারের করের বোঝা বহন করতে হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আদানি গ্রুপ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সুবিধা পেয়েছে। ফলে ভারত সরকারকে সেই কর দিতে হবে না, অর্থাৎ তা আদানির পকেটেই যাবে।
কর কমার কোনো সুবিধা বাংলাদেশ না পেলেও ভারত সরকার যদি কর বা শুল্ক বাড়ায়, তাহলে বাংলাদেশকে ক্যাপাসিটি চার্জের অংশ (জ্বালানিবিশেষজ্ঞ টিম বাকলির মতে, এই ক্যাপাসিটি চার্জের মোট পরিমাণ বছরে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার) হিসেবে অতিরিক্ত ভাড়া ঠিকই দিতে হবে।
এ ছাড়া যুদ্ধ, হরতাল বা আইন পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ না নিতে পারলেও আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ, জরিমানা ও অন্যান্য পাওনা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু একই কারণে আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ না করতে পারলে বাংলাদেশকে তারা কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে না।
৩.
ডেইলি স্টার ও ওয়াশিংটন পোস্ট-এর প্রতিবেদনে উল্লিখিত বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা চুক্তির এসব বিধান পর্যালোচনা করে বিস্মিত হয়েছেন। সিডনিভিত্তিক জ্বালানিবিশেষজ্ঞ টিম বাকলি বলেছেন, এই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশকে পাঁচ গুণ বেশি দাম দিয়ে আদানি থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হতে পারে এবং ‘চুক্তিটি বাংলাদেশের জনগণের টাকায় এশিয়ার সাবেক শীর্ষ ধনীর পকেট ভরার চুক্তি’। তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ রক্ষার আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘এটি কোনো চুক্তি নয়, বরং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী আদানিকে বাংলাদেশের দেওয়া উপহার।’
এই চুক্তির প্রতিবাদ করেছে টিআইবি, সুজন, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনসহ দেশের বিভিন্ন সংগঠন। টিআইবি তার প্রতিবাদলিপিতে বলেছে, ‘...এই চুক্তি আন্তর্জাতিকভাবে নির্ভরযোগ্য বিশ্লেষণে অসম ও অস্বচ্ছ এবং বাংলাদেশের জন্য অভূতপূর্বভাবে বৈষম্যমূলক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।’ খোদ ভারতেই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রামপাল চুক্তি সম্পাদিত হয় যাদের আমলে, সেই কংগ্রেস দল। ভারতের গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি ‘আদানি পাওয়ারের জন্য খুবই লাভজনক এবং বাংলাদেশের জন্য লোকসান’ উল্লেখ করে চুক্তির শর্ত মেনে নিতে নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ‘শেখ হাসিনাকে চাপ দিতে পারে’ বলে মন্তব্য করেছে কংগ্রেস।
এই চুক্তির বিষয়ে গণমাধ্যমগুলো থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি বা কথা বলতে রাজি হননি। চুক্তিটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সম্পাদন করেছিল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী না। বুঝতেই পারছেন এখন সময়টা ঝুঁকিপূর্ণ!’
৪.
আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তিটি (এবং এ ধরনের অন্য যেকোনো চুক্তি) বাতিল বা তা সম্ভব না হলে সংশোধন করতে হবে। এই চুক্তির বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহর মন্তব্য নিয়েছে। তিনি বলেছেন, সরকার জেনেবুঝেই এই চুক্তি করেছে। তারা জানে যে আদানিকে খুশি করলে মোদিও খুশি হবেন।
ভারত বা মোদি খুশি থাকলে আমাদের আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু তা যদি হয় বাংলাদেশের স্বার্থের বিনিময়ে এবং তঁাকে খুশি করতে গিয়ে যদি বাংলাদেশের মানুষকে বাড়তি বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে হয় বছরের পর বছর, তাহলে অবশ্যই আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে।
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক