বাস রুট রেশনালাইজেশন হলো একটি শহরের বিচ্ছিন্ন গণপরিবহনব্যবস্থাকে ঐক্যবদ্ধ কর্তৃপক্ষের অধীন পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া, যার লক্ষ্য যানবাহনের সুষ্ঠু প্রবাহ, যাত্রীদের শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও সেবার গুণগত মান উন্নত করা। যদিও এটির বেশ কয়েকটি সুবিধা আছে, আবার কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
এই চ্যালেঞ্জলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, উচ্চ বিনিয়োগ ব্যয়, বাসভাড়া বৃদ্ধি, অনানুষ্ঠানিক অপারেটরদের প্রতিরোধ ও অপর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা। সীমিত জনসমর্থন, জটিল নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে নতুন ব্যবস্থার সমন্বয় এসব সমস্যা প্রক্রিয়াটিকে আরও জটিল করে তোলে। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের বাসিন্দাদের জন্য এটি সাশ্রয়ী হবে কি না, তার উদ্বেগ এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হওয়াও বাস রুট রেশনালাইজেশনের সফলতার পথে বাধা হতে পারে। এসব প্রতিবন্ধকতার সমাধান করতে সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর শাসন ও দৃঢ় সমন্বয়ের প্রয়োজন। উপরন্তু আরও কিছু বিষয়কে মাথায় রাখা যৌক্তিক মনে করছি। বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক।
ঢাকা নগর পরিবহন নামে পরিচিত বাস রুট রেশনালাইজেশন উদ্যোগটি ঢাকায় একদমই নতুন নয়। ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৫০টি বাস নিয়ে ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটে মতিঝিল ও সাইনবোর্ড হয়ে ট্রায়াল রান শুরু করার পরও উদ্যোগটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
পরীক্ষামূলক এই বাস পরিবহন প্রকল্পে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি) থেকে ৩০টি এবং বেসরকারি অপারেটর ট্রান্স সিলভা থেকে ২০টি বাস চালু করা হয়েছিল। যদিও প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তবু বেসরকারি অপারেটরদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) প্রকল্পটি পর্যবেক্ষণ করেছিল এবং এর কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটিতে (বিআরআরসি) সাপ্তাহিক প্রতিবেদন এবং একটি বিস্তারিত সারাংশ জমা দিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে যাত্রীদের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু সুবিধা লক্ষ করা গিয়েছিল।
যাত্রীরা আরও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে বাসে উঠতে ও টিকিট সংগ্রহ করতে পারছিলেন, বাসগুলো ছিল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং স্টাফরা যাত্রীদের সঙ্গে ভদ্র আচরণ করতেন। সবাই সহজেই বসার জায়গা পেতেন। চালকেরা অন্যান্য বাসকে অতিক্রমের চেষ্টা করতেন না, কারণ ট্রান্স সিলভা ও বিআরটিসির মধ্যে আয় ভাগাভাগির চুক্তি ছিল, যাত্রীর সংখ্যা যা–ই হোক না কেন। তবে এর বাস্তবায়নে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিয়ে প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়।
একই রুটে অনুমোদনবিহীন অনেক বাস অবাধে চলাচল করত, যা পরিবহনব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল এবং নিয়ন্ত্রণ করা ছিল প্রশাসনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
অনুমোদনবিহীন বাসের অবাধ চলাচলের কারণে ট্রান্স সিলভাসহ অন্যান্য পরিবহন কোম্পানির যাত্রীসংখ্যা কমে গিয়েছিল। এ কারণে যাত্রীদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হতো, বিশেষ করে সকাল ও বিকেলের ব্যস্ত সময়ে। এতে যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছিল। একই সঙ্গে অপারেশনাল সমস্যা ও আর্থিক সংকটের কারণে চালক ও সহকারীদের বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হচ্ছিল।
কিছু পরিবহনমালিক চাঁদাবাজি কমে যাওয়ার কারণে নিজেদের আয় কমে যাবে ভেবে এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন। রেশনালাইজেশন প্রকল্প সফল করার জন্য আরও পাঁচটি বেসরকারি পরিবহন কোম্পানিকেও অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ট্রান্স সিলভার আর্থিক সংকট দেখে অন্য কোম্পানিগুলো এ প্রকল্পে যোগদানের ঝুঁকি নিতে চায়নি। এ কারণে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।
ফিলিপাইন দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প সেবু বিআরটি ও ম্যানিলা বিআরটি-১ বাস্তবায়নে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা ও পর্যাপ্ত কারিগরি পরিকল্পনার অভাবে প্রকল্পটি ব্যাপক বিলম্বের সম্মুখীন হয়েছিল এবং অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ব্যর্থ হয়।
ম্যানিলা শহরের প্রকল্পে মোট ১৬টি স্টেশন এবং একটি ১২ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রুট অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর সম্ভাব্য সুবিধা থাকা সত্ত্বেও দুর্বল পরিকল্পনা ও প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, সরকারি–বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল বাস স্ট্র্যাটেজি, যা বাস ব্যাক বেটার নামে পরিচিত, প্রায় ৩ বিলিয়ন বিনিয়োগ করে ২০২১ সালে স্থানীয় পরিবহন কর্তৃপক্ষকে বাস (ফ্র্যাঞ্চাইজিং) ব্যবস্থার অধীন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নে অর্থায়ন সংকট, সেবা কমানো ও ভাড়া বৃদ্ধির মতো বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। ওদিকে লাতিন আমেরিকার মেক্সিকো সিটি, সান্তিয়াগো ও বোগোতা শহরগুলোয় অনানুষ্ঠানিক গণপরিবহনব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিক করার লক্ষ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশনের প্রক্রিয়া বাস অপারেটরদের মধ্যে অন্যায্য প্রতিযোগিতার মতো বেশ জটিল ও চ্যালেঞ্জিং ছিল।
ঢাকায় বাস রুট রেশনালাইজেশনের সাফল্য নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) সার্ভিস একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে সড়ক, রেল ও পানিপথ–সংবলিত সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা (ইন্টিগ্রেটেড ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক) নিশ্চিত হবে। প্রয়োজনে উড়ালপথ ব্যবহারের চিন্তাও মাথায় নিতে হবে।
প্রতিটি শহর এই চ্যালেঞ্জগুলোকে নিজস্ব উপায়ে সমাধান করেছে। সান্তিয়াগো কর্তৃপক্ষ কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রণয়ন ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে যানজট ও দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে। বোগোতা ধীরে ধীরে তার বিআরটি সিস্টেমের সম্প্রসারণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং বর্তমান অপারেটরদের জড়িত করে সুষ্ঠু সমন্বয় নিশ্চিতের চেষ্টা করছে। এ দুই প্রকল্পের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়েছে, দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য সরকারের আরও সুসংহত পরিকল্পনা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
বিআরটির মাধ্যমে বাস রুট রেশনালাইজেশনের ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকায় বেশ কিছু সমস্যা হয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জনঘনত্ব কম, দক্ষ জনবল বা সম্পদের অভাব, ব্যয়বহুল ও অনানুষ্ঠানিক পরিবহন ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার বিআরটি প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
উপরিউক্ত উদাহরণগুলো বিশ্লেষণ করে কিছু সাধারণ চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব, রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, অনানুষ্ঠানিক অপারেটরদের বিরোধিতা, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা, সংস্থাগুলোর মধ্যে দুর্বল সমন্বয়, অনানুষ্ঠানিক বাস পরিষেবা ব্যাহত হওয়া ও ভাড়া বৃদ্ধি।
সুতরাং ঢাকায় বাস রুট রেশনালাইজেশনের সাফল্য নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) সার্ভিস একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে সড়ক, রেল ও পানিপথ–সংবলিত সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা (ইন্টিগ্রেটেড ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক) নিশ্চিত হবে। প্রয়োজনে উড়ালপথ ব্যবহারের চিন্তাও মাথায় নিতে হবে।
এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ত্বরান্বিত করা, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ, রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ, রাস্তায় যত্রতত্র হকার অপসারণ এবং অনানুষ্ঠানিক অপারেটরদের বিরোধিতা মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অননুমোদিত বাসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, নতুন দিয়ে পুরোনো যানবাহন প্রতিস্থাপন নিশ্চিত করা আবশ্যক।
উল্লেখ্য, গাড়ি মালিকানার নিয়ন্ত্রণ, প্রতিটি পরিবারে একটি ব্যক্তিগত গাড়ি সীমাবদ্ধ করা যানজট কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বেসরকারি অপারেটরদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ প্রদান পরবর্তী সেবার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে। নিম্ন আয়ের জনগণের জন্য ভাড়া সহনীয় রাখতে ভাড়া ব্যবস্থাপনা এবং জনগণের সহায়তা অর্জনে জনসচেতনতা কার্যক্রম অপরিহার্য। অধিকন্তু রিয়েল টাইম পর্যবেক্ষণসহ একটি কেন্দ্রীয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ট্রাফিকপ্রবাহ সুসংগঠিত করবে এবং অবৈধ যানবাহন অপসারণ নিশ্চিত করবে, যা বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পটির দীর্ঘমেয়াদি সফলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এখানে উল্লেখ করতেই হবে, বাসমালিক, চালক ও কর্মচারীদের তাঁদের লাভের অংশ নিশ্চিত না করার কোনো বিকল্প নেই।
আরও গভীরভাবে যদি চিন্তা করি, ঢাকা শহরের যোগাযোগ সেক্টরের যেকোনো প্রকল্পের সফলতা নিশ্চিত করতে শহরের ওপর জনসংখ্যার চাপ কমানো এবং শহরের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। উপশহরগুলো অপরিকল্পিত আবাসিক শহর হতে দেওয়া থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
পরিশেষে প্রযুক্তিগত নতুনত্ব, টেকসই পরিবেশগত উন্নয়নের চর্চা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিকেন্দ্রীকরণ মাথায় রেখে এমন স্থাপনা নির্মাণ ও ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যাতে শহরে একটি আদর্শ নাগরিক জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
ড. আরমানা সাবিহা হক যানবাহন সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং সহকারী অধ্যাপক, দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]; [email protected]