সীমিত আয়ের মানুষের কান্না শোনে কে

সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কি বৈষম্যের ব্যবধান কমেছে?ছবি : প্রথম আলো

সব কি চলছে ঠিকঠাকমতো? সীমিত আয়ের মানুষের অল্প চাওয়াগুলো কি পূরণ হচ্ছে? সামাজিক জীবনে তাঁদের কি সত্যিকারের আনন্দ বিদ্যমান? সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কি বৈষম্যের ব্যবধান কমেছে?

কাউকে কুশল জিজ্ঞাসা করা হলে সোজা উত্তর, ভালো নেই! নেতিবাচক এই উত্তর অনেক দিন থেকেই লক্ষণীয়। ভোগবাদ, স্বার্থ, লোভ এবং হালুয়া–রুটির ভাগাভাগি আমাদের সমাজে দৃশ্যমান। লোভীদের অন্যায্য চাহিদা দিন দিন বেড়ে সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অনাচার। অস্থিরতা যেন সর্বত্রই! বৈষম্য–সংস্কৃতি আমাদের দেশটাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে? সীমিত আয়ের মানুষের কান্না কেউ শুনছে না!

শাক-ভাতের সংসার চালাতে গিয়ে প্রতিমুহূর্তে তাদের দীর্ঘশ্বাস! কে দেখে তাদের চোখের জল? বিনিদ্র রাতের মানুষগুলোর অন্তর্মুখী রক্তক্ষরণ কে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসবে? সমাজ-সংসারে বৈষম্য দেখে দেখে সাধারণ মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সংসার চালাতে সাধারণ মানুষের ঋণের ওপর যেমন নির্ভরতা বাড়ছে; তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে হতাশা। এর অন্যতম প্রধান কারণ সীমিত রোজগার, অনিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থা এবং মূল্যস্ফীতি।

নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদেরও দিনকাল ভালো নেই। দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের জন্য সীমিত আয়ের মানুষগুলো সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যাচ্ছে মানুষ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের প্রকৃতি হলো এরা না পারে ওপরে যেতে, না পারে নিচে নামতে। আত্মসম্মানের ভয়ে এরা টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে পারে না।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে প্রবাসীর স্ত্রী রিনা আক্তার (৩১) কদিন আগে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় সায়মা বেগম (৩৫) তার শিশু দুই সন্তানকে নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঋণের চাপে তার এই আত্মহত্যা। ঋণের জ্বালা সইতে না পেরে বছরখানেক আগে সিরাজুল ইসলাম (৫৫) নামের ঝিনাইদহের এক ব্যবসায়ী শেষমেশ বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। সুদের যন্ত্রণা তার হৃদয় কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছে, তা ফুটে উঠেছে জীবননাশের আগে লিখে যাওয়া চিরকুটের অক্ষরে অক্ষরে।

সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সৎ এক লেখক বন্ধু আমার। কিডনি রোগে আক্রান্ত স্ত্রীকে অর্থাভাবে ফল কিনে খাওয়ানোর সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। কারণ, হাতে বাড়তি অর্থ নেই তাঁর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উচ্চশিক্ষিত মধ্যবয়সী একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বেশ ক বছর ধরে আদাবরের ভাড়া বাসায় বসবাস করে আসছেন। যা মাইনে পান, তাতে কোনো রকমে দিন অতিবাহিত হচ্ছিল তাঁর। খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের অঙ্কে তাঁর প্রতি মাসেই টান পড়ে। জমে গেছে কয়েক মাসের বাসা ভাড়া। খরচ মেটানোর দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে তাঁকে। চলতি বছর শেষে পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন দুই সন্তানের মেধাবী এই কর্মজীবী। কারণ, বাড়তি উপার্জন নেই তাঁর।

ঢাকা সিটি কলেজের বিপণন বিভাগের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আহসানুল হক (২১)। মুখে কাপড় বেঁধে রিকশা চালান কুমিল্লার তেলিকোনার এই তরুণ। অনেক কষ্টে রাজধানীর শাহজাহানপুর রেল কলোনির একটি সাবলেটে থাকেন তাঁরা। শহীদবাগ থেকে তাঁর রিকশায় চড়ে মতিঝিল আসছিলাম কদিন আগে। সম্মানের ভয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে প্যাডেল চাপছিলেন অতি কষ্টে। বললেন, সংসারে পাঁচ সদস্যের খাবার জোটাতে কাঠমিস্ত্রি বাবার প্রাণান্তকর অবস্থা। বাবা বলেছেন, তাঁর পড়ার খরচ চালাতে পারবেন না। তাই তিনি ছাত্রাবস্থায়ই উপার্জনের পথে নেমেছেন।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানসিক চাপ বাড়ছে সাধারণ মানুষের। বাড়ছে ঋণের বোঝা। দ্রব্যমূল্য দিনে দিনে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এখন এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যেখানে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। 

তাহলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার কি কোনো অধিকার নেই? রাজা-রানি আসে আর যায় কিন্তু এদের কথা ভাবার মানুষ কোথায়? তেলে মাথায় তেল দেন ক্ষমতাবান এবং নীতিনির্ধারকেরা। দিনে দিনে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষ নিঃস্ব ও দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষদের দুঃখগাথার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দিনবদলের সরকারের গভীরভাবে ভাবার সময় এখনই। কেননা, কষ্টে থাকা সৎ মানুষেরাও তো ক্ষমতার শক্তি। তাঁদেরও আছে শৃঙ্খলিত ও শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচার অধিকার।


প্রণব মজুমদার লেখক ও সাংবাদিক