অটিজম কী, কিছু কারণ এবং আমাদের করণীয়
প্রতিবারের মতো এবারও ২ এপ্রিল পালিত হচ্ছে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। প্রথমেই জানা দরকার, অটিজম কী? বিশ্বায়ন, আকাশ সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি আর চ্যাটজিপিটির বিশেষ উৎকর্ষ সাধনের এই যুগে মানুষ নানা অজানা জ্ঞানের দ্বার উন্মোচন করেছে, অনেক অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু তারপরও কিছু দুঃস্বপ্ন, কিছু ব্যর্থতা নতুন জীবনের আগমনের আনন্দকে ছাপিয়ে অস্বাভাবিকতাসম্পর্কিত নানা বার্তা দিচ্ছে যা জীবনের সব প্রাপ্তি ও অর্জনকে মুহূর্তের মধ্যে ম্লান করে দিতে পারে। আর এই অস্বাভাবিকতা–সম্পর্কিত বার্তাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অটিজম।
খুব সরল ভাষায় বলতে গেলে, একটি শিশু মাতৃগর্ভ থেকে যেসব সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অটিজম। মূলত অটিজমে আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তি মাতৃগর্ভ থেকে মস্তিষ্কের বিকাশগত অসম্পূর্ণতাজনিত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যার ফলে তাকে দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহ ও আচার-আচরণ, গ্রহণমূলক ও প্রকাশমূলক ভাষা ব্যবহার, সংজ্ঞাপন ও সামাজিকতার ক্ষেত্রে নানা মাত্রার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়, যা জীবনব্যাপী চলতে থাকে।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রদর্শিত লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন ভিন্ন ভিন্ন হয়, তেমনি আচরণগত তীব্রতারও মাত্রাভেদ রয়েছে। পাশাপাশি অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ভাষাপ্রকাশ, অনুধাবন ও ব্যবহারেও বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। সব ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শনকারী অটিজমকে একত্রে ‘অটিজম বর্ণালি বৈকল্য’ অভিধায় চিহ্নিত করা হয়। অটিজমের বর্ণালি বৈকল্যকে চিকিৎসকের ভাষায় ইংরেজিতে বলা হয়।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এএসডি)। মানসিক প্রতিবন্ধিতাসহ স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন থেকে উচ্চবুদ্ধির অটিজমে আক্রান্ত মানুষেরা এই স্পেকট্রামের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অব ডিজিজে অটিজমকে একটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এর কোড নম্বর ধরা হয়েছে এফ ৮৪.০।
বর্তমানে সারা পৃথিবীতে সবাই ভাবছে, কেন অটিজম হয়? অটিজম নামক স্নায়ুবৈকল্যজনিত অবস্থাটির জন্য দায়ী কারণগুলো সম্পর্কে গবেষক ও বৈজ্ঞানিক মহল শত প্রচেষ্টার পরও এখনো নির্দিষ্ট একক কোনো কারণ আবিষ্কার করতে না পারলেও ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের মতামত দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা নিম্নরূপ:
১. লিও কনারসহ অনেক গবেষকই এটি নিশ্চিত করেছেন যে অটিজমের সঙ্গে মস্তিষ্কের জিনজনিত বিষয়টি গভীরভাবে সম্পৃক্ত। স্বাভাবিকভাবে যমজ শিশুদের মধ্যে অভিন্ন জিন প্রবাহিত হয়, ফলে যমজদের একজনের মধ্যে অটিজম পরিলক্ষিত হলে অন্যজনের মধ্যেও তা দেখা দিতে পারে।
১৯৭৭ সালে রাটার ও সুসান ফোলস্টাইন ২১ জোড়া যমজ (১১ জোড়া অভিন্ন যমজ ও ১০ জোড়া ভিন্ন যমজ) শিশু নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে জানিয়েছেন যে অভিন্ন যমজের মধ্যে একজনের অটিজম থাকলে আরেকজনের অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি ১০০% না হলেও তা ভিন্ন যমজের তুলনায় সম্ভাবনা বহু গুণে বেড়ে যায়। পক্ষান্তরে ভিন্ন যমজের ক্ষেত্রে একজনের অটিজম থাকলে আরেকজনের অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের সম্ভাবনা মাত্র ৫%।
২. সেরোটনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যপ্রবাহ ও আচরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে যা অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে অতি বেশি মাত্রায় পাওয়া যায়। এতে তারা মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।
৩. শিশুর জন্মগ্রহণের পর আমব্লিক্যাল কর্ড বা নাভিরজ্জু কাটা ও বাঁধার সময় যদি অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় আর অক্সিজেনের ঘাটতির ফলে টিস্যু নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে শিশুর মধ্যে অটিজমের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
৪. অপরিণত বয়সে শিশু জন্মগ্রহণ করলে স্বাভাবিকভাবেই শিশুর ওজন কম হয়। জন্মের পর যদি নবজাতকের ওজন আড়াই কেজি বা তার চেয়ে কম হয়, তাহলে সন্তান অটিজমে আক্রান্ত হতে পারে। তা ছাড়া খুব কাছাকাছি সময়ে অর্থাৎ এক বছরের কম সময়ের ব্যবধানে মা যদি পরপর তিনটি সন্তান ধারণ করেন, তাহলে সেসব শিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৫. আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার এক গবেষণা জরিপে বলা হয়েছে যে গর্ভাবস্থায় যদি মা অনেক উঁচু বাসায় থাকেন এবং বাতাসে সিসার পরিমাণ বেশি থাকে আর তা যদি গর্ভের শিশুকে প্রভাবিত করে, তাহলে শিশুর অটিজম হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
৬. বেশি বয়সে সন্তান নিলে, মা কিংবা বাবা উভয়ের বয়স বেশি হলে এবং মা-বাবার সিজোফ্রেনিয়া বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার থাকলে সন্তানের মধ্যে অটিজম থাকার আশঙ্কা বেড়ে যায়। ২০১১ সালের এক গবেষণায় জানানো হয় যে ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী মায়ের সন্তানের চেয়ে ৪০ বছর বয়সী মায়ের সন্তানের অটিজম থাকার আশঙ্কা শতকরা ৫০ ভাগ বেশি।
৭. স্নায়ুতাত্ত্বিকদের বরাতে জানা যাচ্ছে যে বিষাক্ত রং ও বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে তৈরি খাদ্যসামগ্রী গ্রহণের ফলে মা ও শিশু নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ কারণে অটিজম ও বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
৮. শিশুবিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভাবস্থায় মায়ের রুবেলা সংক্রমণ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা ও ভাইরাস জ্বর থাকার কারণে অ্যান্টিবায়োটিকসহ অতিরিক্ত ওষুধ গ্রহণ অটিজমের মূল কারণ। তা ছাড়া গর্ভাবস্থায় বা সন্তান জন্মানোর সময় যদি মাথায় আঘাত লাগে এবং পাশাপাশি কোনো জটিলতা তৈরি হয়, তাহলে অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে বলে মনে করা হয়।
৯. কোনো মা-বাবার প্রথম সন্তান যদি অটিজমে আক্রান্ত হয়, তাহলে দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে অটিজম থাকার আশঙ্কা বেড়ে যায় ২০ ভাগ। আর দ্বিতীয় সন্তান অটিজমে আক্রান্ত হলে তৃতীয় সন্তানের অটিজম থাকার আশঙ্কা বেড়ে যায় ৩২ ভাগ।
১০. এমএমআর ভ্যাকসিন, খাবারের গ্লুটেন ও ক্যাসিন, ইস্ট থেকে অটিজম হতে পারে সন্দেহ করা হলেও কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১১. এমইসিপি-২ নামক জিনের মিউটেশন বা কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে রেট সিনড্রোম নামক বিরল (কেবল মেয়েদের) অটিজম হয়ে থাকে। রহস্যজনিত কারণে অটিজমে আক্রান্ত প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে চার শিশু ছেলে এবং একজন মেয়ে হয়ে থাকে।
১২. Syn-Gap-I নামক প্রোটিনের ঘাটতি হলে গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে করে শিশুটির অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ক্রোমোজোমাল অঞ্চল 7q11.23–এর অস্বাভাবিকতার সঙ্গে অটিজম বৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যায়।
পরিশেষে বলতে পারি যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, আর্থসামাজিক বৈষম্য ও ভৌগোলিক সীমারেখানির্বিশেষে পৃথিবীর যেকোনো দেশের যেকোনো পরিবারের সদস্যের অটিজম নামক জন্মাবধি নীল দৈত্যটি আক্রমণ করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হচ্ছে শিশুর আচার-আচরণ, চোখের প্রতিক্রিয়ার ধরন ও ভাষার বিকাশ অস্বাভাবিক বলে মনে হলে খুব দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং শিশুটি অটিজম আক্রান্ত কি না তা নিশ্চিত হওয়া।
সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রত্যেক মানুষ যেমন একজন থেকে অন্যজন ভিন্ন, তেমনটি প্রত্যেক অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তিও স্বতন্ত্র। তাই প্রত্যেক অটিস্টিক শিশুর ধরন অনুযায়ী বয়সের ভিত্তিতে দৈনন্দিন জীবন ধারণ কার্যাবলি, আচার-আচরণ, ভাষার ব্যবহার শেখানো এবং শিক্ষা, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় থেরাপি সেবা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করার মাধ্যমে অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তিকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। বিশেষ শিশুর মা-বাবা এবং পরিচর্যাকারীর মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোবল বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত প্রাতিষ্ঠানিক কাউন্সেলিং সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
অটিজমসহ অন্য সব বিশেষায়িত শিশু বা ব্যক্তির জন্য সমাজের মূল স্রোতধারার ব্যক্তির সমান সুযোগ নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি মা-বাবা কিংবা দেখভালের জন্য দায়িত্ববান অতি আপনজনহীন পৃথিবীতে সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়নে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে খুব দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সর্বোপরি, এসব বিশেষ শিশু বা ব্যক্তি সমাজের বোঝা না হয়ে সমবয়সী স্বাভাবিক বিকশিত মানুষের মতো যেন খেলাধুলা ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে, হাসতে পারে, বাঁচতে পারে, বাঁচার মতো বাঁচতে পারে এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করাই হোক এবারের অটিজম সচেতনতা দিবসের মূল লক্ষ্য।
সৈয়দা আছিয়া আক্তার প্রভাষক, অডিওলজি ও স্পিচ ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথলজি বিভাগপ্রয়াস ইনস্টিটিউট অব স্পেশাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (পাইজার), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস।