ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় এসেছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে এমন একটা সময়ে, যখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রায়, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লুণ্ঠনে অর্থনীতিও বিপর্যস্ত।
অন্যদিকে স্বৈরশাসনের অবসানের পর মানুষের মধ্যে জেগে উঠেছে রাষ্ট্র সংস্কার ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের ব্যাপারে বিপুল আশা ও উদ্দীপনা।
অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা তাই অনেক, যা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সভা-সেমিনার, মিছিল-সমাবেশ, সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনার মধ্য দিয়ে উঠে আসছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের মানুষের এই বিপুল প্রত্যাশা পূরণ করতে কতটা সক্ষম, সে বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য এক মাস খুবই কম সময়। তবে এই সময়ে সরকারের বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য, পদক্ষেপ, পরিকল্পনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের অভিমুখ ছাত্র-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার দিকে আছে কি না, তার একটা আভাস পাওয়া যেতে পারে।
এ রকম একটি বিবেচনা থেকে গত এক মাসে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম, পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা মূল্যায়নের চেষ্টা করা হবে। এখানে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের তালিকা যেমন থাকবে, তেমনি যে কাজগুলো যথাযথ হয়নি বা যে কাজগুলোতে এখনো নজর দেওয়া হয়নি অথবা বিভিন্ন রকম ঘাটতি রয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে, সেগুলোও উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারের যে কাজগুলো ভালো লেগেছে
১. জুলাই ও আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচারে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ জানানো;
২. শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির উদ্যোগ, সেই সঙ্গে আহত ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য একটি ফাউন্ডেশন তৈরির উদ্যোগ;
৩. ব্যাংকগুলোকে বড় বড় ঋণখেলাপি ও লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখল থেকে মুক্ত করে পরিচালনা পরিষদ পুনর্গঠন;
৪. দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রভাবশালী দেড় শ ব্যক্তির তালিকা তৈরি ও ৭৯ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু, যাঁদের মধ্যে এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরার মতো বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার সরকারের বিভিন্ন আমলের প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী রয়েছেন;
৫. ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ অর্থাৎ কালোটাকা সাদা করার বিধান বাতিল;
৬. দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা;
৭. গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত;
৮. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্প কিংবা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন আছে—এমন প্রকল্প পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত;
৯. বলপূর্বক গুম হওয়া থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর ও বিগত সরকারের আমলে সংগঠিত গুমের ঘটনা তদন্ত করার জন্য একটি কমিশন গঠন;
১০. দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন;
১১. আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন;
১২. স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন;
১৩. সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ প্রদান এবং প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক সরকার পরিচালনায় ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানানো;
১৪. দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল চালু, শুক্রবারও মেট্রোরেল চালু রাখার সিদ্ধান্ত;
১৫. মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি কিশোরী স্বর্ণা দাশ নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানানো;
১৬. দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দেওয়া;
যেখানে ঘাটতি আছে এবং যে কাজগুলো যথাযথ হয়নি
১. সরকার গণ-অভ্যুত্থানের সময় আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার সব ধরনের দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়নে সমস্যা রয়ে গেছে। এখনো অর্থের অভাবে অনেকে চিকিৎসা করাতে পারছেন না—এ রকম খবর পাওয়া যাচ্ছে।
২. জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট করে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী ও হুকুমের আসামিদের শনাক্ত করা, গ্রেপ্তার ও বিচার করার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে যাঁদের বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাঁদের অপরাধের ধরনের সঙ্গে সম্পর্কহীন ঢালাও মামলা দেওয়া হচ্ছে, যেগুলোর আদালতে টেকার সম্ভাবনা কম।
৩. সরকার পতনের পর পরিবহন খাত থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, ফুটপাত, হাটবাজার, ময়লা সংগ্রহ, বালু উত্তোলন ইত্যাদি খাতে চাঁদাবাজির হাতবদল ঘটেছে কেবল; চাঁদাবাজি বন্ধ করার দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
৪. চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চাহিদা অনুযায়ী বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা, বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া ও বিকল্প ব্যবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষের কাছে অপেক্ষাকৃত কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহ করার তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি;
৫. সচিবালয়সহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এক দলের বদলে অন্য দলের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, ঢালাও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, এর ফলে যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, এমন কর্মকর্তারাও বঞ্চিত হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন;
৬. দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক করা যায়নি, পুলিশ বিভাগ পুরোপুরি কার্যকর হয়নি, যত্রতত্র মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর ঘটনা ঘটে চলেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো সেবামূলক কাজ ঠিকঠাক করতে পারছে না;
৭. কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলনের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল;
৮. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন মানদণ্ড ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে, তা পরিষ্কার করা হয়নি। এতে অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতাসম্পন্ন নিয়োগ হলেও দলীয় বিবেচনায় প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগের অভিযোগ রয়ে গেছে;
৯. গাজী টায়ার কারখানায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা প্রতিহত করতে সময়মতো যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ার ফলে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন, নিখোঁজ মানুষদের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও অবহেলার অভিযোগ রয়েছে;
১০. দাগি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত বেশ কয়েকজন অপরাধীকে একের পর এক জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ঠিক কোনো মানদণ্ড বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটেছে, তা স্পষ্ট নয়;
১১. রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন মাজারে হামলা চালানো হচ্ছে, যা প্রতিহত করতে সরকারের দিক থেকে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না;
১২. নির্বাহী আদেশে রাজনৈতিক স্বার্থে নাগরিকদের ওপর পাইকারি নজরদারি ও মুঠোফোনে আড়ি পাতার জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য এখনো কোনো উদ্যোগ না নেওয়া;
১৩. পুলিশ, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদির সংস্কারের কথা বললেও এগুলো সংস্কারের পদ্ধতিগত দিক স্পষ্ট করা হয়নি, কোনো টাইমলাইন ও রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়নি;
অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাসের কার্যক্রমে এই ঘাটতি বা সমস্যাগুলো থাকার অর্থ এই নয় যে সরকার এই কাজগুলো ঠিকঠাক করবে না বা করতে চাইছে না। আগেই বলা হয়েছে, জনগণের বিপুল প্রত্যাশা পূরণের জন্য এক মাস কোনো সময়ই নয়। তা ছাড়া স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চাইলেই কোনো কাজ যথাযথ বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। তবে এই বাস্তবতার মধ্যেও সরকারের পদক্ষেপের অভিমুখ কোনো কোনো দিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মনে রাখতে হবে, এই সরকারের পক্ষে চাইলেও অল্প সময়ের মধ্যে গত ১৫ বছরের জঞ্জাল সব সাফ করা সম্ভব নয়। এ জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকারের কাজের ফোকাস ও অগ্রাধিকার ঠিক করা এবং সময়ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করে এগিয়ে যাওয়া। আমরা আশা করব, গত এক মাসের ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার ভুলগুলো সংশোধন করে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাবে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি তৈরির দিকে।
কল্লোল মোস্তফা লেখক ও গবেষক