বেশ নাটকীয়ভাবে আরাকানে জুলাই থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধ থামাতে রাজি হলো মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী ও আরাকান আর্মি। বিষয়টা পুরো অঞ্চলের জন্য স্বস্তির। এই যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জাপানের ইউহেই সাসাকাওয়ার উপস্থিতি দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বিশেষ নজর কাড়ল। বাংলাদেশেও অনেকে জানতে চাইছেন, কে এই সাসাকাওয়া? আরাকান বিষয়ে তাঁর আগ্রহের কারণ কী? উত্তপ্ত এই জনপদে তাঁর প্রভাবের জায়গাটি কীভাবে তৈরি হলো? বাংলাদেশের জন্য সাসাকাওয়ার এই উদ্যোগ কোনো বিশেষ বার্তা দেয় কি না?
জাপানের ‘বিশেষ প্রতিনিধি’ ইউহেই সাসাকাওয়া
ইউহেই সাসাকাওয়া মিয়ানমারে জাপানের ‘বিশেষ প্রতিনিধি’। তাঁর দায়িত্ব মিয়ানমার সরকার ও সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চলের সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে ‘জাতীয় ঐক্যের’ লক্ষ্যে কাজ করা। ২০১৩ সালে জাপান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে এই দায়িত্ব দেয়। ইউহেই সাসাকাওয়ার আরেক পরিচয় তিনি নিপ্পন ফাউন্ডেশন ও সাসাকাওয়া পিস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। ব্যক্তি হিসেবেও তিনি অত্যন্ত ধনাঢ্য। গত ৩০ বছরে অসংখ্য রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। সর্বশেষ নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মিয়ানমারে এসেছিলেন। এ সময়েই আরাকানের যুদ্ধরত দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়।
আরাকানে সাসাকাওয়ার সক্রিয়তা
মিয়ানমার-জাপান সম্পর্কের ইতিহাস বহু পুরোনো। মিয়ানমারের স্বাধীনতাসংগ্রামে যেমন জাপানের অবদান আছে, তেমনি এ দেশকে তারা উপনিবেশ বানাতেও চেষ্টা করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সেসব চেষ্টা এবং অপচেষ্টার বিধ্বংসী স্মৃতিচিহ্ন পড়ে আছে নাফের এ পারে চট্টগ্রামেও। কিন্তু জাপান-মিয়ানমার সম্পর্ক মোটেও সেই ইতিহাসে আটকে নেই। ক্রমাগত নতুন নিরীক্ষা চলছে তাতে। সাত-আট দশক আগের পুরোনো ইতিহাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাসাকাওয়াকে জাপান যে মিয়ানমারে ‘জাতীয় ঐক্যের’ কাজে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়, তারই ফল আরাকানের সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি। যার আওতায় মূলত যুদ্ধের কারণে সংকটগ্রস্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো যাবে এবং তাদের চলাচল সহজ করা হবে। সে কারণে বিবদমান উভয় পক্ষ একে বলছে ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’। নিপ্পন ফাউন্ডেশন থেকে এ-ও বলা হচ্ছে, চলতি যুদ্ধবিরতিকে যেন রাজনৈতিক ও সামরিক কোনো চুক্তি হিসেবে বিবেচনা করা না হয়।
এ মাসেই সাসাকাওয়া আবার আরাকানে আসছেন বলে জানা গেছে। এখানে সাসাকাওয়ার সক্রিয়তা এবারই প্রথম নয়। ২০১৯ সালেও একবার আরাকানে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল সাসাকাওয়ার মাধ্যমে। এরপর ২০২০ সালে তিনি জাপান থেকে এসেছিলেন মিয়ানমারের নির্বাচন দেখতে। জাপান সরকার সে সময় তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের প্রধান করে পাঠায় তাঁকে। ওই সময় সু চি সরকার ক্ষমতায় ছিল। তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরুতে আরাকানের বহু এলাকায় ভোট স্থগিত করে রাখে। এ নিয়ে আরাকান আর্মি ক্ষুব্ধ ছিল। কারণ, এখানে নির্বাচন হলে তাদের সমর্থনপুষ্ট স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা জিতে আসতেন, যা সু চির এনএলডির অপছন্দ ছিল। আরাকানে এনএলডির সঙ্গে আরাকান আর্মির সম্পর্কের বড় অবনতি ঘটে এ সময়। যার রেশ এখনো চলছে। তবে সাসাকাওয়ার মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত সু চির সরকার আরাকানের ওই সব এলাকায় নির্বাচন করতে রাজি হয়। তখন থেকে আরাকানের রাজনীতিতে সাসাকাওয়া অধ্যায় বিশেষ গতি পায়। এর মধ্যে সু চি সরকার উৎখাত হলে পুরো দেশে সামরিক শাসন শুরু হয়। পাশাপাশি আরাকান আর্মির সশস্ত্র তৎপরতাও বাড়ে। ২০২০ সালের নভেম্বরে এখানে পুরোনো যুদ্ধবিরতিও ভেঙে যায়। সে অবস্থায় আবারও সাসাকাওয়ার দূতিয়ালিতে নতুন যুদ্ধবিরতিতে আরাকানে বেশ স্বস্তি এল।
আরাকানের যুদ্ধবিরতিতে সীমান্তের এপারে কক্সবাজার ও বান্দরবানেও স্বস্তির আবহ এনেছে। এতে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত বাণিজ্যে পুরোনো ছন্দ ফিরতে পারে। যুদ্ধ এদিকে ছড়িয়ে না পড়লেও আরাকানের গত তিন-চার মাসের উত্তেজনায় বান্দরবানে স্বাভাবিক অবস্থায় যে ব্যাঘাত ঘটে, তাতে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর এক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ ছাড়া আরাকানের যুদ্ধ রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়েও নানানভাবে জটিল করেছিল।
জাপানের কূটনৈতিক বিস্তৃতি বাড়ছে মিয়ানমারে
মিয়ানমারে সাসাকাওয়ার গত দুই বছরের বিভিন্ন কাজে প্রাথমিকভাবে লাভবান জাপান। মিয়ানজুড়ে চীনের বহুমাত্রিক প্রভাব সবার জানা। কিন্তু তার মধ্যেই এখানে সরকার ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মাঝে সাসাকাওয়া যেভাবে সফল সংলাপ করে যাচ্ছেন, তা বেইজিংয়ের জন্য অস্বস্তিকর। যদিও সাসাকাওয়ার ভূমিকায় চীন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নয়; কিন্তু তাঁর মাধ্যমে দেশটির সামরিক ও রাজনৈতিক পরিসরে জাপানের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে, যা জাপানের বৈশ্বিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও সুখকর। সাসাকাওয়া পিস ফাউন্ডেশনের পাঁচটি ঘোষিত প্রধান লক্ষ্যের একটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের বন্ধুত্ব জোরদার; আরেকটি হলো ‘এশিয়ায় জাপানের উপস্থিতি বাড়ানো’। সাসাকাওয়ার ভূমিকা আরাকান ও পার্শ্ববর্তী চিন প্রদেশের পালেতোয়া এলাকায়ও স্থানীয়ভাবে অভিনন্দিত হচ্ছে; কারণ, এতে দুই বছরের ব্যবধানে দুই দফা এখানকার মানুষ উপকৃত হলো। সেপ্টেম্বর থেকে এসব অঞ্চলে জাতিসংঘের কোনো ত্রাণ সংস্থাও কাজ করতে পারছে না মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাতমাদার নিষেধাজ্ঞার কারণে।
আরাকানে সাসাকাওয়ার এই ভূমিকা মিয়ানমারের অন্যান্য বিবাদপূর্ণ এলাকায়ও তাঁর দূতিয়ালির সম্ভাবনা তৈরি করেছে, যা এখানে আসিয়ানের ব্যর্থতার পটভূমিতে জাপানের বাড়তি কূটনৈতিক ভূমিকা ও দক্ষতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ন্যাশনাল ইউনিটি সরকার (এনইউজি) মনে করে, জাপান এখানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সামরিক বাহিনীকে যথেষ্ট চাপ দিচ্ছে না। এমনকি জাপানের অনেক সহায়তা গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে জান্তার যুদ্ধাভিযানে সহায়ক হচ্ছে। সর্বশেষ আরাকান যুদ্ধেও তাতমাদা এমন কিছু নৌযান পরিবহন কাজে ব্যবহার করেছে, যেগুলো জাপান মিয়ানমারে ওডিএ (অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স) সহায়তা হিসেবে দিয়েছিল। এনইউজি চায়, জাপানও ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা অবরোধে শামিল হোক। তবে সাসাকাওয়া যে এ রকম আহ্বানে সাড়া দেননি, সেটি বোঝা যায় জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে তাঁর বৈঠক। দেশটির ওপর মহলে ঘনিষ্ঠতার জোরেই এপ্রিলে তিনি মিয়ানমারে জান্তার হাতে আটক জাপানি সাংবাদিক ইউকি কিতাজুমিকে ছাড়িয়ে নিতে পারলেন।
যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী হবে
আরাকানের চলতি ‘যুদ্ধবিরতি’ এখানকার জাতিগত যুদ্ধ মোটেও থামাবে না। কারণ, ওই যুদ্ধের মৌলিক কারণগুলো সবই আগের মতো বহাল আছে। এমনকি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে আরাকান আর্মি ও তাতমাদা প্রদেশের পশ্চিম দিকে বাংলাদেশের কাছাকাছি এলাকায় যার যার সামরিক অবস্থান শক্তভাবে ধরে রেখেছে। আরাকানে আগেও একাধিকবার যুদ্ধবিরতি সমঝোতা হয়ে তা ভেঙে পড়ার নজির আছে। তবে এবারের যুদ্ধ যেভাবে স্থানীয় সমাজে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা তৈরি করে, সেটি হয়তো এখন কমবে। এই এলাকায় এখন ধান চাষের মৌসুম, যা স্থানীয়ভাবে প্রধান শস্য। যুদ্ধবিরতি হয়তো নির্বিঘ্নে চাষাবাদের সুযোগ দেবে সেখানকার মানুষকে। যাদের কেউ কেউ যুদ্ধের কবল থেকে বাঁচতে এলাকাছাড়া হয়ে আছেন। গত নভেম্বরে আরাকানে নানান সহিংসতায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৯০ হাজার। সর্বশেষ চার মাস যুদ্ধের অংশ হিসেবে তাতমাদা আরাকানের বহু জনপদকে ঘিরে অবরোধতুল্য অবস্থা কায়েম করেছিল। মূলত এ কারণেই আরাকান আর্মি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। তাদের দিক থেকে এটা একটা কৌশলগত অবস্থান। তাতমাদার দিক থেকেও তাই। অন্তত একটা প্রদেশে সরকারের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি ও খরচপাতি কমল যুদ্ধবিরতিতে।
বাংলাদেশের জন্য নতুন বার্তা
আরাকানের যুদ্ধবিরতিতে সীমান্তের এপারে কক্সবাজার ও বান্দরবানেও স্বস্তির আবহ এনেছে। এতে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত বাণিজ্যে পুরোনো ছন্দ ফিরতে পারে। যুদ্ধ এদিকে ছড়িয়ে না পড়লেও আরাকানের গত তিন-চার মাসের উত্তেজনায় বান্দরবানে স্বাভাবিক অবস্থায় যে ব্যাঘাত ঘটে, তাতে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর এক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এ ছাড়া আরাকানের যুদ্ধ রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়েও নানানভাবে জটিল করেছিল। মিয়ানমারের এই প্রদেশে সাসাকাওয়া এবং জাপানের ভূমিকা রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের ভাবনা, পরিকল্পনা ও নির্ভরতায় অবশ্যই নতুন উপাদান যুক্ত করছে। বাংলাদেশের দক্ষিণে এটা অবশ্যই একটা নতুন মুহূর্ত। বিশেষ করে যখন ইউহেই সাসাকাওয়ার চীনের সঙ্গে কাজেরও অভিজ্ঞতা রয়েছে।
● আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক