জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরা অবশেষে তাঁর বিরুদ্ধে আনা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। সরকারবিরোধী প্রচার এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে দুটি মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে ২০২০ সালের অক্টোবরে। ২০২২ সালের ২৭ আগস্ট তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আপিল বিভাগের নির্দেশে ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করেন। দ্বিতীয় মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হন তিনি গত ২৯ ফেব্রুয়ারি।
‘নির্দোষ খাদিজার ১৫ মাস কে ফিরিয়ে দেবে’, এ প্রশ্ন তুলেছেন সোহরাব হাসান ৪ মার্চ প্রথম আলোয় তাঁর এক লেখায়। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে এটি ছাড়াও খাদিজার গ্রেপ্তার ও বিচার নিয়ে আরও কিছু প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে।
১. খাদিজার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সরকারবিরোধী প্রচার এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার। সরকারবিরোধী প্রচার কি অপরাধ হতে পারে? আমাদের সংবিধানে তো এখনো বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিদ্যমান। সরকার ভালো কাজও করে এবং সে জন্য অবশ্যই প্রশংসা পেতে পারে। তবে পৃথিবীতে তো এমন কোনো সরকার নেই, যা সম্পূর্ণ নিখুঁত, যে সরকার কোনো ভুল বা খারাপ সিদ্ধান্ত নেয় না।
আমাদের দেশের সরকারও নিশ্চয় নিখুঁত নয়। সে রূপ ভুল বা খারাপ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ গণতন্ত্র এবং বাক্স্বাধীনতার একেবারেই প্রাথমিক ধাপ। এটা কী করে অপরাধ হয়?
২. এরপর ভাবমূর্তির মতো একটি বিমূর্ত বিষয়ের প্রশ্ন। দেশের ভাবমূর্তির মাপকাঠি হলো, দেশ নিয়ে বিদেশের মানুষ বা প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত ধারণাটি কী রকম, তা-ই না? নিজেদের নিয়ে যতই উচ্চ ধারণা আমাদের থাকুক না কেন, বাংলাদেশ নিয়ে দেশের বাইরে প্রচলিত ধারণা (ভাবমূর্তি) কী, তা উপলব্ধি করতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূচকের দিকে তাকাতে হবে।
৩০ বছর ধরে উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, এতে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়, উজ্জ্বল হয় যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লিঙ্গসমতা অর্জিত হয়, যখন দারিদ্র্য হ্রাস পায়, যখন নিউইয়র্কের একজন বাঙালি ট্যাক্সিচালক তাঁর যাত্রীর ফেলে যাওয়া অর্থের থলি তাঁকে খুঁজে বের করে ফেরত দেন, যখন দেশ থেকে কেউ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় তখন, যখন দুর্নীতির ধারণা, আইনের শাসন বা সুশাসন সূচকে আমাদের অবস্থান হয় তালিকার নিচের দিকে, যখন হাইব্রিড রেজিম থেকে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রেও উত্তরণ ঘটে না, যখন ভোটপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যখন সরকারি বাহিনী দ্বারা গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ ওঠে, যখন বিপুলসংখ্যক বিরোধী নেতা-কর্মীকে জেলে আটকে রাখায় জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান উদ্বেগ প্রকাশ করেন, যখন ইউরোপে বেআইনি অনুপ্রবেশের চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মৃত ব্যক্তিদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হয় বাংলাদেশের তরুণ।
খাদিজাতুল কুবরা কী বললেন, তাতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় না, ক্ষুণ্ন হয় যখন তাঁকে কথা বলার ‘অপরাধে’ অন্তরীণ করা হয়। যে মাননীয় বিচারক নির্দোষ মেয়েটির বিরুদ্ধে করা মামলা দুটি বাতিল করে দিয়েছেন, তিনি শুধু ন্যায়বিচারই করেননি, একই সঙ্গে তিনি বিচারালয়ের এবং সেই সঙ্গে খানিকটা দেশেরও ভাবমূর্তি এগিয়ে নিয়েছেন।
খাদিজাতুল কুবরা কী বললেন, তাতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় না, ক্ষুণ্ন হয় যখন তাঁকে কথা বলার ‘অপরাধে’ অন্তরীণ করা হয়। যে মাননীয় বিচারক নির্দোষ মেয়েটির বিরুদ্ধে করা মামলা দুটি বাতিল করে দিয়েছেন, তিনি শুধু ন্যায়বিচারই করেননি, একই সঙ্গে তিনি বিচারালয়ের এবং সেই সঙ্গে খানিকটা দেশেরও ভাবমূর্তি এগিয়ে নিয়েছেন।
৩. কারও কোনো বক্তব্যে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলো কি না, সে সিদ্ধান্ত কে নেয়? কলাবাগান ও নিউমার্কেট থানার পুলিশ খাদিজার বিরুদ্ধে মামলা দুটি করেছিল। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা উপপরিদর্শক কি এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা রাখেন যে খাদিজার বক্তব্যে বিশ্বের কোন প্রান্তে কার মধ্যে বাংলাদেশ সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হলো? নাকি যেকোনো রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিরঙ্কুশ অধিকার দেওয়া হয়েছে পুলিশকে?
৪. আরেকটি বিষয়ে আমার মনে হয় মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখতে পারেন। অত্যন্ত কম বয়সী একটি মেয়ে, কথিত ‘অপরাধ’ সংঘটনের সময় যার বয়স নাকি ১৮ বছরের কম ছিল, তাঁকে জেলে আটকে রাখার জন্য পুলিশ এবং সরকারের আইন কর্মকর্তাদের এমন একনিষ্ঠ এবং অনমনীয় প্রতিজ্ঞা কেন?
গ্রেপ্তার যদি করা হয়েও থাকে, এ বয়সের একটা মেয়ের প্রতি তো স্বাভাবিক মানবিক সহানুভূতিও থাকার কথা। তা না করে বিচারিক আদালতে যাতে তাঁর জামিন না হয়, সে ব্যবস্থা তাঁরা করেছেন। ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট খাদিজার জামিন মঞ্জুর করেন। অন্তত এখানে তো তাঁরা থামতে পারতেন। এরপর কেন জামিন স্থগিত করার জন্য তাঁরা চেম্বার আদালতে গেলেন?
খুনি, ধর্ষক, সন্ত্রাসীরা জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসে এবং ভুক্তভোগীর ওপর চাপ দেয় মামলা তুলে নেওয়ার জন্য; এ মেয়েটার তো তেমন কিছু করার সুযোগ ছিল না। দুর্ধর্ষ অপরাধী দেশত্যাগের দুই ঘণ্টা পর তাঁকে আটকানোর নির্দেশ বিমানবন্দরে পৌঁছায়, এ মেয়ে তো মনে হয় না তেমন কিছু করতে পারতেন। তাহলে তাঁর জামিন আটকানোর জন্য কেন এত ব্যাকুলতা?
৫. সংক্ষুব্ধ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বিচারালয়। মাননীয় বিচারকেরা অনেক ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও অন্যায়, অন্যায্যতার বিরুদ্ধে নির্দেশনা দেন। খাদিজাতুল কুবরা শেষ পর্যন্ত অব্যাহতি পেয়েছেন আদালতেরই নির্দেশে। আদালতের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, এই যে নির্দোষ মেয়েটি, কোনো অপরাধ না করে যাঁকে ১৫ মাস জেলে কাটাতে হলো, এমনকি জামিন পেতেও তাঁর এই পরিমাণ সময় লাগল, এটি কি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী নয়?
৬. খাদিজাতুল কুবরা নির্দোষ ছিলেন। যাঁরা এত পরিশ্রম, সময় এবং সরকারের অর্থ ব্যয় করে তাঁকে এই হয়রানির শিকার করেছেন, তাঁরা কি জবাবদিহির আওতায় আসবেন?
এতটা আশাবাদী বোধ হয় না হওয়াই ভালো।
● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব