সেন্ট মার্টিন ঘিরে আসলে কী হচ্ছে

নাফ নদীতে মিয়ানমারের জলযান এসেছিল, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করার জন্য। মংডুর পতন ঠেকানোই এর লক্ষ্য।ছবি : প্রথম আলো

কৌশলগত দিক থেকে সেন্ট মার্টিন খুব গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ নয়। কারণ, এটা খুবই ছোট একটা প্রবালদ্বীপ। নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেও দ্বীপটি খুব নিরাপদ নয়। নাফ নদীর পশ্চিম অংশ বাংলাদেশে, পূর্ব অংশ মিয়ানমারে পড়েছে। মিয়ানমারের উপকূলটা যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখব, সেটা শাহপরীর দ্বীপ থেকে নিচের দিকে নেমে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে অনেকটা ফানেলের মতো। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বাংলাদেশের জলসীমার মধ্য দিয়ে যেতে হলেও কিছু জায়গা পড়ে মিয়ানমারের খুব কাছাকাছি।

রাখাইন অঞ্চলে একটা গৃহযুদ্ধ চলছে। আরাকান আর্মি রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের ১৭-১৮টি শহর এরই মধ্যে দখল করে নিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে এখন মূল লড়াইটা চলছে মংডু শহরকে কেন্দ্র করে। এই শহরকে আরাকান আর্মি ঘেরাও করে ফেলেছে। শহরটি বাংলাদেশের একেবারেই সীমান্তসংলগ্ন।

বাংলাদেশের সীমানার কাছে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের দুটি পোস্ট রয়েছে। যত দূর জানা যাচ্ছে, দুটি পোস্টই আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। রাখাইনের মানচিত্রটা যদি দেখি, তাহলে দেখব দুটি পোস্ট আরাকান আর্মি দখল করার ফলে মংডুর সঙ্গে সিত্তের সংযোগকারী সড়কটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। একই সঙ্গে রাথিডং দখল হয়ে যাওয়ায় মংডুর সঙ্গে ইয়াঙ্গুনের সংযোগ রাস্তাটিও অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

আমাদের ট্রলার, স্পিডবোট লক্ষ্য করে গুলি করার আশঙ্কা আরাকান আর্মির দিক থেকেই বেশি। এর কারণ হলো, তারা মনে করছে, রোহিঙ্গা, আরসা ও আরএসওকে সশস্ত্র করছে এবং আরাকানে পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। তাদের এই দাবি সত্যি নাকি মিথ্যা, তা বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকেও কোনো বিবৃতি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়নি।

একটা বিষয় হচ্ছে, আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কর্মকাণ্ড নিয়ে তাদের নানা সন্দেহ রয়েছে। যতটুকু খবরাখবর পাওয়া যায়, আরএসও ও আরসা সশস্ত্র হয়ে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী তাতমাদোর পক্ষে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

জানা যাচ্ছে, বুথিডং শহরের পতনের পর সেখান থেকে কয়েক হাজার (৩০ থেকে ৫০ হাজার) রোহিঙ্গা পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরাকান আর্মি অবশ্য রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, মিয়ানমারের বিমানবাহিনীর গোলায় এসব বাড়িঘর পুড়েছে।

ভারতের সঙ্গে আরাকান আর্মির ঐতিহাসিক বিরোধ আছে, কিন্তু তারাও কিন্তু অতীত ভুলে ভবিষ্যতে কাজ করার কথা বলছে। সেটা অবশ্য পর্দার পেছনে। মনে রাখতে হবে, অন্য কোনো দেশকে সম্পৃক্ত না করে আমাদের নিজেদেরই যা করার করতে হবে। যদি অন্য কোনো দেশ যুক্ত হয়, তাহলে এলাকাটি বড় একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। ভূরাজনৈতিক বড় বিপর্যয় ঘটারও ঝুঁকি রয়েছে। এমন কিছু এড়াতে বাংলাদেশকে তার নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি, মিয়ানমারের গানবোট অথবা নেভাল শিপ নাফ নদীতে অবস্থান নিয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা তাদের নিজস্ব জলসীমায় আছে কি না। তারা যদি তাদের সীমানার মধ্যে থাকে, তাহলে আমাদের দিক থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া আইনিভাবে বৈধ হবে না।

আমার ধারণা, নাফ নদীতে মিয়ানমারের জলযান এসেছিল, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করার জন্য। মংডুর পতন ঠেকানোই এর লক্ষ্য। কারণ, মংডু আরাকান আর্মির দখলে চলে গেলে রাখাইনের রাজধানী সিত্তের পতনও আসন্ন। তার মানে উত্তর রাখাইনে সেনাবাহিনীর যে সদর দপ্তর আছে, সেটারও পতন হবে এবং উত্তর রাখাইন পুরোটাই আরাকান আর্মির দখলে চলে যাবে। এই পরিস্থিতিতে সড়কপথগুলো অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তাতমাদো নৌবাহিনীকে ব্যবহার করা শুরু করে থাকতে পারে।

মংডুর পতন হলে তা হবে তাতমাদোর জন্য বড় একটা ধাক্কা। সেখানে এক লাখের মতো রোহিঙ্গা আছে। তাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আরাকান আর্মি মংডু দখলে নিলে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নতুন করে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে। আরাকান আর্মিকে প্রতিরোধ করা কিংবা তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে মীমাংসা করার মতো শক্তি রোহিঙ্গাদের নেই।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কাছে বিকল্প কী? আরাকান আর্মি নন-স্টেট অ্যাক্টর (রাষ্ট্রবহির্ভূত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী)। এ রকম একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে একটা রাষ্ট্র খোলাখুলি যোগাযোগ করতে পারে না। বাস্তবতা হলো, আমাদের সীমান্ত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রবহির্ভূত গোষ্ঠীর হাতে। মংডু দখল হলে পুরোটাই আরাকান আর্মির হাতে চলে যাবে। এ অবস্থায় আমাদের সরকারকে প্রথমত ভাবতে হবে, তারা কি আরাকান আর্মির সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনায় যাবে কি না। সে ক্ষেত্রে আরাকান আর্মির মতো একটি নন স্টেট অ্যাক্টরের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার ঝুঁকি নিতে হবে।

দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে, পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়া। সেটা পাল্টা আক্রমণ হতে হবে, তা নয়। কিন্তু আরাকান আর্মি অথবা মিয়ানমারের সেনা বা নৌবাহিনীর যারাই আমাদের সমুদ্র সীমানা অতিক্রম করুক না কেন, তাদের সতর্ক করতে কিছু পাল্টা পদক্ষেপ আমাদের অবশ্যই নিতে হবে।

পরিশেষে বলব, ভারতের সঙ্গে আরাকান আর্মির ঐতিহাসিক বিরোধ আছে, কিন্তু তারাও কিন্তু অতীত ভুলে ভবিষ্যতে কাজ করার কথা বলছে। সেটা অবশ্য পর্দার পেছনে। মনে রাখতে হবে, অন্য কোনো দেশকে সম্পৃক্ত না করে আমাদের নিজেদেরই যা করার করতে হবে। যদি অন্য কোনো দেশ যুক্ত হয়, তাহলে এলাকাটি বড় একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। ভূরাজনৈতিক বড় বিপর্যয় ঘটারও ঝুঁকি রয়েছে। এমন কিছু এড়াতে বাংলাদেশকে তার নিজস্ব স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশ সূক্ষ্ম সুতার ওপর দিয়ে হাঁটছে। সাধারণভাবে দেশের জনগণ মনে করছে, কূটনৈতিক চিঠি বা এ ধরনের পদক্ষেপে কাজ হবে না। যত সীমিত আকারেই হোক আমাদের পাল্টা জবাব দিতে হবে।

● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

[email protected]