চট্টগ্রামে শ্রমিক লীগের থানা পর্যায়ের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ লেখা যখন লিখছি, তখন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, ভাঙচুর, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে সারা দেশে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সুতরাং, একটি জেলার একজন শ্রমিকনেতাকে গ্রেপ্তারের ঘটনা সাধারণ দৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনাই নয়।
কিন্তু সরকার যখন দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ধ্বংস বা যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় সরাসরি জামায়াত-শিবির ও বিএনপিকে দায়ী করছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুযোগে ছাত্রদের কাঁধে সওয়ার হয়ে ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে আঙুল তুলছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর, তখন শ্রমিক লীগ নেতার গ্রেপ্তারের ঘটনা তাত্পর্য বহন করে বৈকি।
চট্টগ্রামে বিআরটিসির বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় ক্লোজড সার্কিট টিভি ক্যামেরার (সিসিটিভি) ফুটেজ দেখে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সোহেল রানা নামের এক লেগুনাচালককে।
চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সোহেল জানিয়েছেন, নগরের বায়েজিদ থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি দিদারুল আলমের নির্দেশে বিআরটিসির বাসে আগুন দেন তিনি। এই অপকর্মের জন্য দিদার তাঁকে চার লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অগ্রিম হিসেবে দেওয়া হয় ৫০০ টাকা।
তথ্যপ্রমাণ হাতে নিয়েই দিদারুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে আগেও ছিল খুনের মামলা। সরকারি দলের শ্রমিক সংগঠনের কোনো নেতার বিরুদ্ধে এ রকম হাতেনাতে ধ্বংসাত্মক কাজের অভিযোগ পাওয়া গেলে বিরোধী দলগুলোর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করার নৈতিক জোর থাকে কি না, সেটা পরের প্রশ্ন; তার আগেই জানতে ইচ্ছা করে, আদৌ এ নিয়ে দলের ভেতরে কোনো বোধোদয় বা আত্মসমালোচনা আছে কি না।
এ প্রশ্নের উত্তর, না। সেটা বোঝা যায় চট্টগ্রাম নগর শ্রমিক লীগের সভাপতি বখতিয়ার উদ্দিনের বক্তব্যে। তিনি বলেন, দিদারুলের বিরুদ্ধে এটা ষড়যন্ত্র হতে পারে।
কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই–অনুসন্ধান ছাড়াই এ রকম একটি কথা বললেন নগর শ্রমিক লীগ সভাপতি। এ রকম তাত্ক্ষণিক মন্তব্যের পর আসলে বলার কিছুই থাকে না। শুধু এই প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খায়, বিএনপির অঙ্গসংগঠন শ্রমিক দলের কোনো স্থানীয় নেতা যদি এ রকম কোনো অপকর্মের দায়ে অভিযুক্ত হতেন, তাঁর ক্ষেত্রেও কি একই রকম ‘সহানুভূতি’ প্রকাশ পেত? ‘দলকানা’ শব্দটির ব্যবহার বোধ হয় এসব ক্ষেত্রেই সুপ্রযুক্ত হয়ে ওঠে।
দিদারুল আলম সম্পর্কে নগর শ্রমিক লীগ সভাপতির মন্তব্যের পর এখন অন্য নেতারা বলতে শুরু করেছেন, দিদার যদি নাশকতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর দায় দল নেবে না।
সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোতে, বিশেষ করে সরকারি দলে এই একটি প্রবণতা চালু হয়েছে। নেতারা অপরাধকর্মের সঙ্গে দলের কোনো নেতা-কর্মীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলেই বলেন, এর দায় দল নেবে না। কিন্তু যে লোকটি দলের একটি থানা-কমিটিতে স্থান পেলেন, এমনকি সভাপতির মতো পদ বাগিয়ে নিলেন, তিনি কীভাবে বা কার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সহযোগিতায় সেখানে পৌঁছালেন, তার অনুসন্ধান হবে না?
নেতাদের টাকাপয়সা দিয়ে দলীয় কমিটিতে পদ পাওয়ার গল্প তো এখন আর লুকোছাপার বিষয় নেই। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায়। তাই দেশের কোনো ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করার আগে সরকারি দলের নিজের ঘরের দিকে তাকানোর প্রয়োজন আছে।
যে দিদারুল বিআরটিসি বাসে আগুন দেওয়ার জন্য চার লাখ টাকা ব্যয় করতে চেয়েছিলেন, তিনি কত টাকা ব্য়য়ে দলের একটি থানা শাখার সভাপতি হয়েছিলেন, সেটা অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসতে পারে অনেক কিছুই।
কেন তিনি সরকারি সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন এবং কে বা কারা তাঁর জন্য এই পথ সুগম করেছিলেন, সেই কেঁচো খুঁড়তে গেলে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে। সুতরাং সেই চেষ্টা দলের কেউ করবেন বলে মনে হয় না।
এদিকে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক সংবাদ থেকে জানা গেল, চট্টগ্রামের চন্দনপুরা থেকে ছাত্রদলের এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যাঁর বাবা উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি।
পিতা ও পুত্র আদর্শিকভাবে ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে সহিংসতায় অংশ নেওয়া তরুণটিকে গ্রেপ্তারের পর কিছু কথা মনে আসতে বাধ্য।
উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি কি সত্যিই একজন আদর্শবান রাজনীতিক ছিলেন? সে ক্ষেত্রে ভিন্ন রাজনৈতিক দল বা আদর্শের অনুসারী হলেও এই প্রবীণের প্রতি তরুণের সমীহ অটুট থাকার কথা। কিন্তু সহিংসতায় অংশ নিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, পিতার রাজনৈতিক জীবন ও কর্মকাণ্ডের ওপর রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ ছিলেন তিনি।
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে সারা দেশে সরকারি দলের জেলা-উপজেলা ও থানা পর্যায়ের নেতাদের দাপট, আর্থিক দুর্নীতি ইত্যাদি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার একটি নির্মোহ অনুসন্ধান হলে অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সে ব্যাপারে দলের নীতিনির্ধারকেরা খুব একটা আগ্রহী বলে মনে হয় না। বরং বিরোধী দলের ‘ষড়যন্ত্র’ উদ্ঘাটনে তাঁদের আগ্রহ সীমাহীন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার দায়ে চট্টগ্রামে স্বেচ্ছাসেবক দলের দুই নেতার নামে মামলা দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ওই দুই নেতা দুদিন আগে থেকেই কারাবন্দী।
এসব উদ্যোগের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশাসনের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়। এভাবে প্রশাসনের সহায়তায় হয়তো বিরোধী দলের নেতা-কর্মীকে সাময়িকভাবে মাঠছাড়া করা সম্ভব, কিন্তু নিজের দলের কাঠামোর ভেতরে যে ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে, তার আক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় কী?
● বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক