কয়েক দিন অগে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জাতিসংঘে দেশটির জাতিসংঘের দূতের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। কংগ্রেসম্যান বব গুডের সই করা টুইট বার্তায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের মানুষের সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার রয়েছে।
কংগ্রেসম্যানরা জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের সদস্যপদ স্থগিতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োগ দেওয়া স্থগিত রাখারও আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, বছর দুই আগে র্যাবের সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বাংলাদেশ সরকার এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁদের এই পর্যবেক্ষণ কবে নাগাদ শেষ হবে, কেউ বলতে পারছেন না। ইতিমধ্যে বাতাসে নানা ‘গুজব’ ভেসে বেড়াচ্ছে।
এর আগে ছয় কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে মার্কিন সরকার কী ভূমিকা নিচ্ছে, তা জানতে চেয়ে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে চিঠি লিখেছেন। ওই চিঠির পর অন্তত দুটি প্রতিনিধিদল এসে নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতিনিধি ও নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা কথা বলেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও।
দুই দফায় ২০ মার্কিন কংগ্রেসম্যানের বিবৃতি ও চিঠিতে আওয়ামী লীগের নেতারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের দাবি, বিএনপি নেতারা মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের কাছে ধরনা দিয়ে এসব চিঠি লেখাচ্ছে। মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের এসব চিঠি ও যোগযোগে যারা এত দিন বিচলিত ছিলেন, শুক্রবারের ঘটনায় তারা কিছুটা আশ্বস্ত হবেন। কংগ্রেসম্যান অ্যান্ড্রু গারবারিনোর (নিউইয়র্ক কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্ট-২) সম্মানে নিউইয়র্কে বাংলাদেশি প্রবাসীদের একটি প্রতিনিধিদল সংবর্ধনার আয়োজন করে। সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন বলেন, গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে যে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে, সেটা বাকি বিশ্বের জন্য উদাহরণ হতে পারে।
এককথায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনটি এখন সীমান্ত পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি যে জনগণ, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অঙ্কুরেই বিনাশ হয় কি না, সেটা রাজনীতিকেরা কমই মনে রাখেন। যেসব কংগ্রেসম্যান এত দিন সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তমূলক ভোট করার কথা বলে আসছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের বিএনপিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অ্যান্ড্রু বলেন, ‘আসন্ন জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি স্বাধীন কমিশনের হাতে তুলে দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বাধীন কমিশনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা দেশকে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারে এবং তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।’
তবে মার্কিন কংগ্রেসম্যান ও অন্যান্য দেশের সমর্থন পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির টানাটানি আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত চলতে থাকবে।
দুর্ভাগ্য হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা বাংলাদেশের জনগণের জন্য রাজনীতি করলেও তাদের ওপর পুরোপুরি ভরসা করেন না। নির্বাচন এলেই বিভিন্ন দেশে তাঁদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল ভারত সফর করে এসেছেন বিজেপির নেতাদের আমন্ত্রণে। তার আগে গত মে মাসে আওয়ামী লীগের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল চীন গিয়েছিল। বর্তমানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বে আরেকটি প্রতিনিধিদল ভারত সফরে আছে।
এরই মধ্যে আনন্দবাজার ও ডয়চে ভেলে পরিবেশিত একটি খবর আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। ওই খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ওয়াশিংটনে একটি কূটনৈতিক বার্তা পাঠিয়েছে নয়াদিল্লি। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে তা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র কারও পক্ষেই সুখকর হবে না। কারণ, শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে জামায়াতে ইসলামীর মতো সংগঠনের ক্ষমতা বাড়বে বলে মনে করে ভারত।
নয়াদিল্লি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও চায় বাংলাদেশে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যে মন্তব্যগুলো করেছে, তা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করে ভারত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জন্মের সময় থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মসৃণ থেকেছে। যখনই সে দেশে অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় এসেছে, দুই দেশের সম্পর্ক ততটা মসৃণ থাকেনি। তাই ভারত সব সময়ই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সরকারকে গুরুত্ব দেয়।’
আগামী সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলন শুরু হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও আসবেন। এই সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হতে পারে। তার আগে এই কূটনৈতিক বার্তা কী বার্তা দিচ্ছে? কূটনৈতিক অঙ্গনের লোকজন জানিয়েছেন, দিল্লি যদি ওয়াশিংটনে কোনো বার্তা পাঠিয়েও থাকে, এ ভাষায় পাঠাবে না। কূটনীতিকেরা কখনো মাঠের ভাষা ব্যবহার করেন না।
যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের কূটনৈতিক বার্তার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুই ধরনের কথা বলেছেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আঞ্চলিক রাজনীতির বিষয়ে এই ভূখণ্ডে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। তাই ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু বললে তারা তাদের স্বার্থে বলেছে।’ বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি ভারত কোনো পদক্ষেপ নেয়, সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা মনে করি, সেটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য এবং এই অঞ্চলের মানুষের জন্য শুভ হবে না।’ তবে তিনি আশা করেন, বাংলাদেশের মানুষের যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষাকে ভারত মর্যাদা দেবে।
এই বিবৃতির পাশাপাশি বিদেশিদের সহায়তা-সমর্থন নিয়ে বাগ্যুদ্ধও চলছে। কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেন, বিএনপি কেবল বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়। সাম্প্রতিক কালে তাঁরা বলতে শুরু করেছেন, বিদেশিরাও বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। জবাবে বিএনপির নেতারা বলেছেন, তাঁরা বিদেশিদের কাছে যান না; আওয়ামী লীগই বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়।
এককথায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনটি এখন সীমান্ত পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি যে জনগণ, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অঙ্কুরেই বিনাশ হয় কি না, সেটা রাজনীতিকেরা কমই মনে রাখেন। যেসব কংগ্রেসম্যান এত দিন সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তমূলক ভোট করার কথা বলে আসছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের বিএনপিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এখন যে একজন কংগ্রেসম্যান সরাসরি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করলেন, তাকে কি আওয়ামী লীগপন্থী কংগ্রেসম্যান বলা হবে?
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এত দিন আমেরিকান কার্ডই একমাত্র আলোচনার বিষয় ছিল। চীন ও রাশিয়া তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখালেও সেটি কেউ গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। ভারত এত দিন প্রকাশ্যে কিছু বলেনি।
কিন্তু ওয়াশিংটনে পাঠানো নয়াদিল্লির কথিত কূটনৈতিক বার্তাটি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে নতুন করে চাপান-উতোর শুরু হয়েছে। এটাই কি ভারতকার্ড হিসেবে বিবেচিত হবে?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি