হোয়াটসঅ্যাপ বয়স্কদের জন্য। ৩০ বছরের বেশি বয়সীরা এটি ব্যবহার করে। আমার প্রথম বর্ষের মেডিকেল শিক্ষার্থীরা আমাকে এটা বলেছে। কোভিড মহামারির সময় সরকারের নীতি নিয়ে কানাঘুষার একটা ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল হোয়াটসঅ্যাপ। অ্যাপটির ব্যবহারকারীরা গ্র্যাজুয়েশনের ছবিসহ নানা তথ্য আদান-প্রদান করেন। কিন্তু তরুণেরা, বিশেষ করে শিশু-কিশোরেরা স্ন্যাপচ্যাট অ্যাপ ব্যবহার করে। যুক্তরাজ্যে ১৩-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই অ্যাপটি ব্যবহার করে। প্রতি মাসে যুক্তরাজ্যের ২ কোটি ১০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী স্ন্যাপচ্যাটে সক্রিয়। সংখ্যাটি যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ। প্রত্যেকে গড়ে দিনে ৫০ বারের বেশিবার অ্যাপটিতে প্রবেশ করে।
১৯৮০ অথবা ১৯৯০-এর দশকে আমরা যদি ফিরে যায়, তাহলে তখন বাবা-মায়ের মূল উদ্বেগের বিষয় ছিল তাঁদের সন্তানদের শারীরিকভাবে কীভাবে নিরাপদে রাখা যায়। ওই সময় ১৪ বছরের একটা ছেলে বা মেয়ে যদি তার ঘরে একা থাকতে চাইত, সেটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় বলে মনে করা হতো। সন্তানদের সঙ্গে কোনো বন্ধু দেখা করতে আসছে এবং তারা বাজার থেকে কী কিনে আনছে, সেগুলো তদারকি করাটাই বাবা-মায়ের জন্য যথেষ্ট ছিল।
২০২৩ সালে এসে ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের ঘরে থেকেও ভার্চ্যুয়াল জগতে কতটা নিরাপদ? তাদের সামনে এখন একটি অবারিত ভার্চ্যুয়াল বিশ্ব। সেখানে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছাড়াই যেকোনো কনটেন্ট বা আধেয় তারা দেখতে পাচ্ছে। মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাবের মতো ডিভাইসে তারা সময় কাটাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফিসহ আরও অন্ধকার জগতের হাতছানি রয়েছে।
কিশোর বয়সীরা যে সমস্যাটির মুখে পড়ে সেটা হলো, এসব অ্যাপ প্রায় সময়ই এমনভাবে নকশা করা যে তাতে আসক্তি জন্মায় অথবা বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে পরিচিত এই অ্যাপগুলো যে ক্ষতি করছে, এ বিষয়ে আওয়াজ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ফলে শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল বিবেক মূর্তি কিছু সুপারিশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাবা-মায়েরা সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি আমাকে করেন তা হলো, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি আমার বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ?” উত্তর হলো, আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ নেই, যাতে বলা যাবে এটা নিরাপদ। প্রকৃতপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, এমন তথ্য-প্রমাণ বাড়ছেই। তরুণ জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যগত সংকটের মধ্যে আমরা আছি এবং আমার উদ্বেগ হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই সংকট সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি।’
অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে কোম্পানিগুলো এ ধরনের কোনো আইন প্রণয়নে বাধা সৃষ্টি করবে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট অথবা অন্য যেকোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আয়ের ৯৮-৯৯ শতাংশ আসে ব্যবহারকারীরা তাঁদের ডিভাইসের স্ক্রিনে যে বিজ্ঞাপন দেখেন, তার মাধ্যমে। বাচ্চারা যত বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করবে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তত অর্থ আয় করতে পারবে। সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হচ্ছে আগামী প্রজন্মের।
আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জ্যাক রেসনেক আরও কঠোর ভাষায় বলেছেন, ‘আমেরিকার তরুণ জনগোষ্ঠী অবাধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। এই অ্যাপস ও সাইটগুলো যে বিশাল ঝুঁকি তৈরি করছে ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে, সেটা আমরা সবে পুরোপুরিভাবে বুঝতে শুরু করেছি।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির যে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, সেটা সত্যিই উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ইয়ুথ রিস্ক সার্ভের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে এর একটা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের মধ্যে পরিচালিত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে এক বছর ধরে ক্রমাগত খারাপ লাগার অনুভূতি ছিল। ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করবে কি না, এ বিষয়ে গভীরভাবে ভেবেছে। জরিপ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, দিনে তিন ঘণ্টার বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটানো কিশোর বয়সীদের মধ্যে বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তায় ভোগার ঝুঁকি দ্বিগুণ। এ ছাড়া ১৩-১৭ বছর বয়সীদের ৪৬ শতাংশ তাদের শরীরের গঠন নিয়ে বাজে ধারণা পেয়েছে এবং ৬৪ শতাংশ মাঝেমধ্যে অথবা প্রায়ই ঘৃণাভিত্তিক আধেয়ের মুখোমুখি হয়েছে।
এ থেকে কীভাবে তারা সরে আসবে, এ বিষয়ে তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তার বোধ রয়েছে। ১১-১৫ বছর বয়সী মেয়েদের তিনজনের একজন জানিয়েছে, নির্দিষ্ট অ্যাপের প্রতি তারা আসক্ত। ৫০ শতাংশ টিনএজার জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বের হয়ে আসা তাদের জন্য খুব কঠিন।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব বাথের গবেষকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বেরিয়ে আসার পর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব পড়ে, এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবেশ না করলে সপ্তাহে গড়ে ৯ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বেরিয়ে আসার মাত্র সাত দিন পরই অন্যদের তুলনায় তাদের মধ্যে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ কম দেখা গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যের ওপর যে ক্রমাগত নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ঐকমত্য বাড়ছে। আমরা এখন পর্যন্ত স্মার্টফোনের বাজে প্রভাবের কারণে সন্তানদের মধ্যে যে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা সমাধানের জন্য মা-বাবা ও অন্য অভিভাবকদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যে নেতিবাচক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করছে, তা খুঁজে বের করার দায় সরকারের। শিশুদের কাছে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যেন বিপজ্জনক কোনো কিছু বিক্রি না করে, এ বিষয়ে নীতি তৈরির দায় রয়েছে তাদের। একই সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ারও দায়িত্ব রয়েছে সরকারের। কোম্পানিগুলো যেন তাদের ডিভাইস ও অ্যাপগুলো এমনভাবে ডিজাইন করে, যাতে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, সেই নীতি ঠিক করা প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে কোম্পানিগুলো এ ধরনের কোনো আইন প্রণয়নে বাধা সৃষ্টি করবে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট অথবা অন্য যেকোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আয়ের ৯৮-৯৯ শতাংশ আসে ব্যবহারকারীরা তাঁদের ডিভাইসের স্ক্রিনে যে বিজ্ঞাপন দেখেন, তার মাধ্যমে। বাচ্চারা যত বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করবে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তত অর্থ আয় করতে পারবে। সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হচ্ছে আগামী প্রজন্মের।
দেবী শ্রীধর এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিষয়ে চেয়ার
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে