জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সময়ের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ, তবে যখন বিশ্ব একটি ক্রমবর্ধমান জলবায়ু সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ভারত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী নেতৃত্বের ভূমিকায় পদার্পণ করছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উদ্ভাবন ও সফট পাওয়ার কূটনীতির সংমিশ্রণ দিয়ে সজ্জিত হয়ে দেশটি শুধু সাহসী জলবায়ু প্রতিশ্রুতিই নির্ধারণ করেনি, বরং সেগুলো বাস্তবায়ন করে বিশ্বের মঞ্চে বিশ্বাসযোগ্য নেতা হিসেবে আবির্ভূতও হয়েছে। কার্যকলাপ ও ন্যায্যতা—উভয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ভারতের প্রচেষ্টা উন্নয়নশীল দেশগুলো কীভাবে জলবায়ুবিষয়ক দায়িত্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে, সেটার একটি আকর্ষণীয় আখ্যান হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।
জলবায়ু প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা
মাথাপিছু দুই টন কার্বন নিঃসরণসহ ভারত জি–২০ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, যা বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশ নিয়ে গঠিত। এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, যা ২০৩০ সালের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে। তবু মোট কার্বন নিঃসরণে ভারতের অংশ মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
ভারতের জলবায়ু প্রতিশ্রুতিগুলো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও পরিমাপযোগ্য, যা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় একটি মানদণ্ড তৈরি করেছে। ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত ইউএনএফসিসিসি সম্মেলনে পাঁচ দফা কর্মপরিকল্পনা বা পঞ্চামৃত ঘোষণা করেন। এগুলোর মধ্যে ২০৭০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নিঃসরণ অর্জনের প্রতিশ্রুতি, ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট অজীবাশ্ম জ্বালানি সক্ষমতা স্থাপন ও একই বছরের মধ্যে ভারতের মোট জ্বালানি চাহিদার ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে নিশ্চিত করার লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ভারত এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের পথে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারত তার জিডিপির নির্গমন তীব্রতা ৩৬ শতাংশ কমিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন থেকে পৃথক করার ক্ষেত্রে একটি বিরল সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। ভারতে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৪৬ শতাংশেরও বেশি অজীবাশ্ম জ্বালানি উৎস থেকে আসে, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা—বৃহৎ জলবিদ্যুৎসহ—২০৩ দশমিক ২২ গিগাওয়াটে পৌঁছেছে। এখন ভারতের মোট ভূমির ২৫ দশমিক ১৭ শতাংশজুড়ে বন ও বৃক্ষের আচ্ছাদন রয়েছে, সঙ্গে ২০০৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আরও ২ দশমিক ২৯ বিলিয়ন টন বাড়তি কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমপরিমাণ কার্বন সিঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
সফট পাওয়ার ডিপ্লোম্যাসি: বৈশ্বিক জোট গঠন
ভারতের জলবায়ু নেতৃত্ব শুধু দেশীয় সাফল্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; দেশটি তার সফট পাওয়ার ব্যবহার করে জলবায়ুর স্থিতিস্থাপকতা, জ্বালানি রূপান্তর ও স্থায়িত্বের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর প্রতি নজর দিয়ে বৈশ্বিক সহযোগিতা গঠন ও নেতৃত্ব প্রদান করেছে। প্রায়ই আনুষ্ঠানিক ইউএনএফসিসিসির আলোচনার বাইরে কাজ করা এসব উদ্যোগ সহযোগিতামূলক সমাধান প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ভারতের প্রচেষ্টাকে দৃঢ় করে।
২০১৫ সালে ভারত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স (আইএসএ) এই নেতৃত্বের উদাহরণ। প্রধানত গ্লোবাল সাউথ অঞ্চলের ১০৪টি সদস্যদেশ ও ১৬টি স্বাক্ষরকারী দেশকে একত্র করে আইএসএ সৌরশক্তিকে টেকসই উন্নয়নের একটি মূল সমাধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো ও প্রযুক্তির পরিবর্তনকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে ভারত ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েছে।
একইভাবে ২০১৯ সালে শুরু হওয়া কোয়ালিশন ফর ডিজাস্টার রিজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার (সিডিআরআই) অবকাঠামোর ক্ষেত্রে জলবায়ু–ঝুঁকির প্রতি বাড়তে থাকা সংবেদনশীলতার ব্যাপারে দৃষ্টিপাত করে। ৪১টি সদস্যদেশ ও ৭টি সংস্থা নিয়ে এটি কার্যকর সমাধানের মাধ্যমে স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে, যা এই বারবার ও বিধ্বংসী জলবায়ুসৃষ্ট দুর্যোগের যুগে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা।
২০২৩ সালে জি–২০ সভাপতিত্ব চলাকালে ভারত বৈশ্বিকভাবে জৈব জ্বালানির গ্রহণযোগ্যতা ত্বরান্বিত করতে গ্লোবাল বায়োফুয়েলস অ্যালায়েন্স (জিবিএ) প্রতিষ্ঠা করে। ২৪টি সদস্যদেশ ও ১২টি আন্তর্জাতিক সংস্থা নিয়ে গঠিত জিবিএ এমন বিকল্প টেকসই জ্বালানির প্রচার করে, যা নিঃসরণ কমায় ও জ্বালানিনিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
২০১৯ সালে সহপ্রতিষ্ঠিত লিডারশিপ গ্রুপ ফর ইন্ডাস্ট্রি ট্রানজিশন (লিডআইটি) হলো আরেকটি উদ্যোগ, যা ভারী শিল্প খাতগুলোর কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে। বিভিন্ন দেশ, প্রতিষ্ঠানসহ এর ৩৭টি সদস্য ২০৫০ সালের মধ্যে ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো শিল্পে নেট-জিরো নিঃসরণ অর্জনের জন্য একযোগে কাজ করে থাকে।
ভারতের মিশন লাইফ (লাইফস্টাইল ফর এনভায়রনমেন্ট) ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায় উভয় পর্যায়ে আচরণগত পরিবর্তন ঘটানোর প্রতিশ্রুতি আরও জোরালোভাবে তুলে ধরে। টেকসই ব্যবহার ও উৎপাদনপ্রক্রিয়াকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে ভারত শুধু নিঃসরণ মোকাবিলা করছে না, বরং পরিবেশগত তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মনোভাবের পরিবর্তনও ঘটাচ্ছে। ভারতের জি–২০ সভাপতিত্ব চলাকালে ৩৯টি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সংস্থার একটি উদ্যোগ, রিসোর্স এফিশিয়েন্সি সার্কুলার ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রি কোয়ালিশনের (আরইসিইআইসি) সূচনা হয়, যা সম্পদ নিষ্কাশন ও বর্জ্য হ্রাসের দিকে মনোনিবেশ করে। সার্কুলার অর্থনীতিকেন্দ্রিক এসব প্রচেষ্টার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উদ্যোগ, যেমন গ্রিন ক্রেডিট প্রোগ্রাম, রাইট-টু-রিপেয়ার উদ্যোগ ও আপডেটেড ইকো-মার্ক বিধিমালা যুক্ত হয়েছে।
গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বের একটি পরিকল্পনা
ভারত অন্য দেশগুলোকে অভিন্ন লক্ষ্যগুলোকে ঘিরে একত্রিত করে বাস্তব বিশ্বের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করার জন্য কার্যকর কাঠামো প্রদান করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক জোট গঠন করে, ভারত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বৈশ্বিক জলবায়ু সংলাপে সমান অংশীদার হিসেবে অংশগ্রহণ করার সক্ষমতা প্রদান করে।
যদিও গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো বিশ্বব্যাপী নিঃসরণে সামান্য অবদান রেখেও জলবায়ু প্রভাবের ভার বহন করছে, ভারতের প্রচেষ্টা এটিও প্রদর্শন করে যে জলবায়ুবিষয়ক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব ধনসম্পত্তির দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং এটি দূরদৃষ্টি ও সংকল্প কর্তৃক নির্ধারিত হয়।
এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে বহুপাক্ষিকতার ওপর আস্থা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে নানাবিধ অংশীজনকে একত্র করার ব্যাপারে ভারতের সক্ষমতা একটি সহযোগিতামূলক, ন্যায়সংগত ও টেকসই ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে আদর্শ উপস্থাপন করে। বৈশ্বিক জলবায়ু কার্যক্রমের নতুন অধ্যায়ের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারত পথ দেখাচ্ছে। ভারত শুধু বৈশ্বিক জলবায়ু সংলাপের অংশগ্রহণকারীই নয়—ভারত এর পথচলার গতি নির্ধারণ করছে। এটি হলো অনুপ্রেরণার মাধ্যমে নেতৃত্ব।
(ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)
মঞ্জীব সিংহ পুরী ইইউতে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং ইউএনএফসিসিসিতে প্রধান আলোচক; বিশিষ্ট ফেলো, দ্য এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট, নয়াদিল্লি
শৈলি কেদিয়া সিনিয়র ফেলো ও সহযোগী পরিচালক, দ্য এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট, নয়াদিল্লি